ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ খ্যাত বরিশাল জেলা। এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হচ্ছে রানী দুর্গাবতীর দুর্গাসাগর। দুর্গাসাগর মূলত বিশাল বড় একটি দীঘি। সাগর নাম যুক্ত করে এর বিশালত্ব বোঝানো হয়েছে। এ দীঘি পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান এবং মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ভরপুর।
প্রতিনিয়ত দর্শনার্থী এ দীঘির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশ থেকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম দীঘি দুর্গাসাগর বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বানারীপাড়া-বরিশাল সড়কের পাশে অবস্থিত।
এ দীঘির মোট জমির আয়তন ৪৫ দশমিক ৫৫ একর। এর মধ্যে মূল দীঘি ২৭ দশমিক ৩৮ একর জায়গা ঘিরে। দীঘির চারপাশে ও মাঝখানের দ্বীপটিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, ঔষধি ও বনজ বৃক্ষ রয়েছে। দীঘির চারপাশে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার হাঁটাপথ রয়েছে। বিশাল এ দীঘির মাঝখানে সুন্দর জঙ্গলপূর্ণ ছোট্ট দ্বীপের মতো একটি টিলা বা ঢিবি রয়েছে। দর্শনার্থীর অন্যতম আকর্ষণ মাঝখানের দ্বীপটির সৌন্দর্য।
তবে পাড় থেকে দ্বীপে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং যাওয়ার অনুমতিও দেয়া হয় না। দীঘির মাঝখানের দ্বীপটি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে সারাক্ষণ। এখানে আছে সুবিশাল সিমেন্টের ৩টি প্রশস্ত ঘাটলা।
দীঘির পাড়ে সরু রাস্তা, মাঝেমধ্যে বসার জন্য বেঞ্চ, সবুজ বৃক্ষরাজি, পাখির কলকাকলি, মাতাল হাওয়া ইত্যাদির পাশাপাশি দুর্গাসাগরের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মোহিত করে পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের। বাতাসের বেগ একটু বেশি হলেই দুর্গাসাগরে ঢেউ ওঠে। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এ দীঘি অনাবিল প্রশান্তির অন্যতম কেন্দ্র।
সম্পূর্ণ দীঘিটি উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। শখের মৎস্য শিকারিরাও এখানে আসেন, বিশাল আকৃতির মাছ ধরার জন্য। বছরে অন্তত দু’বার টিকিট কেটে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে এখানে। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পবিত্র স্নানের উদ্দেশ্যে এখানে সমবেত হন। স্নান উৎসবের সময় এখানে বড় মেলা বসে।
কথিত আছে, সাগরঘেঁষা প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ বারবার বর্মি আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের অবাধ লুণ্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় শ্রীনগর তথা মাধবপাশায় চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়ণ। রাজবাড়ির কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।
বেশকিছু দীঘি থাকলেও তার অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে। যাওবা রয়েছে, তা এখন শুধু কালের সাক্ষী। রাজবংশের উত্তরসূরিরা বর্তমানে ভারতে বসবাস করছেন।
১৯৫০ সালের দাঙ্গায় জমিদার বাড়িতে কয়েকশ’ হিন্দুকে হত্যা করা হয়। শিব নারায়ণের স্ত্রী রানী দুর্গাবতী ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রজাদের খাবার পানির কষ্ট লাঘবের জন্য বিশাল এ দীঘিটি খনন করান। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতী ও প্রজাবৎসল। তার নামেই দীঘিটি দুর্গাসাগর নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, রানী সিদ্ধান্ত নিলেন- তিনি একবারে যতটুকু জমিতে হাঁটতে পারবেন, দীঘি ততটুকু খনন করা হবে এবং হয়েছেও ।
ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগরের সেই জৌলুস এখন আর নেই। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে আবদুর রব সেরনিয়াবাত দীঘিটি পুনঃখনন ও সংস্কার করেছিলেন। এরপর থেকে অদ্যাবধি দীঘিটির সংস্কার বা উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
দুর্গাসাগরের প্রধান প্রবেশদ্বার ‘আবদুর রব সেরনিয়াবাত’ ফটকের রঙ ও পলেস্তরা ওঠে জরাজীর্ণ হলেও আজ পর্যন্ত তা মেরামত বা রঙ করা হয়নি। এছাড়া স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা দুর্গাসাগরের প্রধান প্রবেশদ্বারের পাশেই সীমানা দেয়াল ভেঙে ফেলেছে, যা মেরামতের কোনো উদ্যোগই নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে সন্ধ্যা হলেই দুর্গাসাগর নেশাখোরদের দখলে চলে যাচ্ছে। এছাড়া দিনের বেলায় বখাটেদের উৎপাত তো আছেই। সীমানা দেয়াল ভাঙা থাকায় দর্শনার্থী ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়।
দীঘি এলাকায় নিষেধ থাকা সত্ত্বেও অবাধে গবাদিপশু চড়ায় স্থানীয় লোকজন। এতে যেমন দর্শনীয় এ স্থানটির সৌন্দর্য ম্লান হচ্ছে, তেমনি পশুর যত্রতত্র মলত্যাগে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
বিগত বছরগুলোয় শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দুর্গাসাগরে ভিড় করত। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও শিকারিদের উৎপাতে অতিথি পাখিরা এখন আর আসে না। অন্তত পাঁচটি প্রজাতির কয়েক হাজার পাখির কলকাকলিতে যে দীঘি মুখরিত থাকত, আজ সেখানে বিরানভাব বিরাজ করে।
পর্যটনের অন্যতম স্থান হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এ দীঘিটির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ২৩২ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ দীঘিটির সংস্কার ও উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলে দুর্গাসাগর তার হারানো জৌলুস ফিরে পেয়ে হয়ে উঠতে পারে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান।