একজন শিক্ষক জাতীয় সঙ্গীতকে কবিতার মতো করে বলতে পারেনি। মান্যবর ডিসি শিক্ষকের বেতন স্থগিত করে দিলেন। শিক্ষকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ক্রেস্ট/ সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করতে চেয়ে আবেদন জানিয়ে টিভি সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এর জন্য তাঁদের কে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। কী অদ্ভুত নিয়ম তাই না? কেবল মাত্র শিক্ষকদের বেলায় এমন ঘটনা এদেশে সাধারণ চিত্রে পরিণত হয়েছে। যুগে যুগে শিক্ষকতার মত পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে আজকের যুগে সবচেয়ে অবহেলিত পেশার নাম কী জানতে চাইলে যে উত্তর ভেসে আসবে তা নিশ্চয়ই সবার জানা। শিক্ষকদেরকে শুধু মৌখিকভাবে সম্মান জানিয়েই কি তাঁদের প্রাপ্যতা পেয়ে যায়? শিক্ষকদের আম জনতা কীভাবে সম্মান জানাল কি জানাল না সেটা প্রশ্ন নয়। শিক্ষকরা যাদের অধীনে কাজ করেন সেই কর্তা ব্যক্তিরা কি শিক্ষকতা পেশাকে সম্মান জানায়? এ প্রশ্নটি ইদানিং মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় এটি প্রযোজ্য। মাঠ পর্যায়ে শিক্ষক কী কী কাজে ব্যস্ত থাকেন সেটি হয়তো কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিরা ভুলেই যান। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নানান কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কয়েকটি কাজের কথা না বললেই নয়- ভোটার তালিকা হালনাগাদ, উপবৃত্তি, স্টুডেন্ট প্রোফাইল, শিশু জরিপসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকতে হয়। একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেয়ার পূর্বেও কিছু কাজ করে ক্লাসে যেতে হয়। এছাড়াও আছে সকাল ঠিক নয়টায় বিদ্যালয়ের আগমনের নির্দেশনা। নয়টার মধ্যে উপস্থিতি না হতে পারলেও কখনো কখনো উর্ধতন কর্মকর্তা ‘শোকজ’ এর চিঠি শিক্ষকের কাছে এসে যায়। এছাড়াও উর্ধতন কর্মকর্তা কে না জানিয়ে টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে গেলেও কৈফিয়ত তলব করা হয়। বিদ্যালয় বন্ধের দিনে ব্যাংক তো আর খোলা থাকে না! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককদের শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্টের পরিমাণ সম্ভবত বেশি হবে। নারী শিক্ষকদের বেলায় পরিমাণটা আর একটু বেশি। বর্ষার দিনে বৃষ্টি ঝড় যতই আসুক ‘রানার এর ছুটে ‘ চলার মতো তাঁকেও বিদ্যালয়ের দিকে ছুটতে হয়।সংসার, একজন গৃহিনীর সব দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি শিক্ষকতাকে মত পেশায় যুক্ত থাকায় বিদ্যালয় এর সকল কাজে অংশ নিয়ে থাকেন। এসব কষ্টও শিক্ষকরা হাসিমুখে মেনে নেয়ার সাহস বুকে লালন করেন। শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মানসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেন। কিন্তু শিক্ষকদের দেখভালের জন্য প্রতিষ্ঠান এর কর্মকর্তা কী সেই পরিশ্রম এর কথা মনে রাখেন? চুন খসলে যা হয় শিক্ষকদের বেলায় তেমন দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ নজরে রাখেন। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিক সময়ে তিন শিক্ষককে কোনো ধরনের ‘শোকজ’ বিধি অনুসরণ না করেই ‘সাময়িক বরখাস্ত ‘ এর আদেশ দিলেন। এই সাময়িক বরখাস্ত এর আদেশ দেয়ার ফলে কী অধিদপ্তরের ভাবমূর্তি দেশ বিদেশে উজ্জ্বল হয়েছে? দেশ বিদেশের মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে কাদের ভাবমূর্তি প্রকাশ পেয়েছে? বরখাস্তকৃত শিক্ষকদের ‘অন্যায়’ তারা প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ক্রেস্ট নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। আচ্ছা এই ‘অপরাধে’ কী শিক্ষকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়? প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক নেয়ার আবেদনের বিপরীতে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রকারান্তরে কী বার্তা দিয়েছে?
এদেশের আইন, আদালত কী বলে? আইন বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। নাকি শিক্ষকরা অবহেলিত বলে সব শোষণ সহ্য করার শক্তি অর্জন করেছে? মন মর্জি মোতাবেক শিক্ষকদের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা যায়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উর্ধতন কর্মকর্তারা কী আমাদের ‘শিক্ষক’ মনে করেন? একজন ‘শ্রমিক’এরও আছে সামাজিক মর্যাদা। শ্রমিকের ওপর অবিচার করা হলে শ্রমিক সংঠন এর নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করে রাজপথে উপস্থিতি জানান দেয়। ফলে তাদের দাবি দ্রুত পূরণ করা হয়। শিক্ষকরা আজ নানান সংগঠনের অধীনে যুক্ত হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর এই সুযোগে শিক্ষকদের ওপর যা ইচ্ছা তাই প্রয়োগ করা যাচ্ছে। আজ ‘মাহবুব স্যার’ বরখাস্ত আমার কী ক্ষতি? এই প্রশ্ন যাদের মনে গেঁথে রেখেছেন তাদের যে কাল ‘মাহবুব স্যার’ এর মতো হবে না এমন নিশ্চয়তা কী? দেশের নানান দপ্তরের অধীনস্থ কর্মচারীদের যোগ্যতা অনুযায়ী ‘পদ পদবি’ পরিবর্তন এর নাম করে বেতন বাড়ানোর আয়োজন দেখা গেলেও শুধুমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ল না। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগামী চার্ট এর হিসাব শিক্ষকদের প্রযোজ্য নয়। বিশ্বাস করি উর্ধতন কর্মকর্তারা সব কিছু দেখেন। মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর হয়ে গেছেন ১০ম গ্রেডের ‘ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ‘ কিংবা ‘ কর্মকর্তা ‘ কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ১৩তম গ্রেডের কর্মচারী রয়ে গেলেন। আসুন আরও ‘সংগঠন’ এর সংখ্যা বাড়িয়ে ‘চিরদিন’ ১৩তম গ্রেডের ‘ কর্মচারি’ হয়ে ‘শিক্ষকদের’ মতো মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি!! আর এও ভাবতে থাকি ‘ঢিল’ টি তো আমার মাথায় এসে পড়েনি!
মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন
বরিশাল।
riazuddinbsl@gmail com