শনিবার ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   শনিবার ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ



স্বাধীন দেশে মতপ্রকাশের পরাধীনতা
প্রকাশ: ৩ মার্চ, ২০২৩, ১:৪১ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

স্বাধীন দেশে মতপ্রকাশের পরাধীনতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :

লেখকের লেখা এবং লেখকের স্বাধীনতা এক বস্তু নয়। লেখক হুমায়ুন আজাদের প্রাণনাশের চেষ্টায় যা আক্রান্ত হয়েছিল, তা হলো লেখকের স্বাধীনতা। স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের কারণে ইতোপূর্বে কয়েকজন সাংবাদিক নিহত ও আহত হয়েছেন। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সাগর-রুনি দম্পতি। সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের প্রাণ-সংশয় দেখা দিয়েছিল স্বাধীনভাবে লেখার কারণেই। সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখির কারণে অভিজিৎ রায়সহ বেশ কয়েকজন ব্লগারকে এবং তাঁদের গ্রন্থ প্রকাশের কারেণ ফয়সল আরেফিন দীপনসহ কয়েকজন প্রকাশককে খুন হতে হয়েছে। বেশ কয়েকজন ব্লগার ও প্রকাশক প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়েছেন।

ধর্ম ব্যবসায়ীরা শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফকে (প্রয়াত) ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করেছে; তাঁর বাসায় বোমা ফেলেছে; তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁকে জব্দ করতে চেয়েছে। বিপদ ঘটেছিল লেখক তসলিমা নাসরিনেরও। ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাঁকে কতল করার জন্য তলোয়ার হাতে রাস্তায় ছোটাছুটি করেছে। সরকার তাঁকে কোনো প্রকার নিরাপত্তা দেয়নি। প্রকাশ্যে যারা তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে; তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো করেইনি; উল্টো তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা করে অপরাধে-উন্মুখদের হাত শক্তিশালী করেছে।

এমন ঘটনা পরাধীনতার আমলেও ঘটেনি। কাজী নজরুল ইসলাম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কবিতা, গান ও প্রবন্ধ লিখতেন। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বই সরকারের রোষানলে পড়ে নিষিদ্ধ হয়ে যেত। পত্রিকা সম্পাদনার দায়ে তাঁকে কারারুদ্ধও করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাণনাশের চেষ্টা হয়নি। পাকিস্তান আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত খর্বিত ছিল। এমনকি সেকালেও লেখার অপরাধে লেখককে হত্যাচেষ্টার কথা আমরা শুনিনি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে তা ঘটছে। ব্লগার, লেখক সাংবাদিকদের নিহত ও নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় আসামিরা ধরা পড়ছে না; তাদের বিচার হচ্ছে না। বরং নানাভাবে তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে।

তসলিমা নাসরিন বা হুমায়ুন আজাদের অনেক বক্তব্য নিয়েই বিতর্ক আছে। অনেকের কাছে তাঁর কোনো কোনো মন্তব্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একই কথা বলা চলে ব্লগারদের ব্যাপারেও। কিন্তু বই লেখা বা মতপ্রকাশের জন্য বিবরবাসী ঘাতকদের হাতে লেখক বা প্রকাশকের প্রাণ বিপন্ন হবে এবং তাঁদের কাউকে কাউকে দেশত্যাগী হতে হবে– এমন ঘটনা যে রাষ্ট্রের জন্য ব্যর্থতার পরিচয়বহ এবং দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত গভীর দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নয় শুধু; মানুষের জীবনই আজ নানাভাবে বিপন্ন। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই; খুন, ডাকাতি, ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ; ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে; ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলার ঘটনাগুলোও বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারুক; অপরাধীদের অপরাধের স্বাধীনতা বেশ ভালোভাবেই দিয়ে চলেছে। এ পরিস্থিতির কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করলে অবস্থা আরও খারাপ হতে বাধ্য।

আশার কথা, দেশের মানুষ আত্মসমর্পণে প্রস্তুত নয়। যে কারেণ লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধিক্কার ও প্রতিবাদ আমরা দেখেছি। শুধু দেশে নয়; দেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশের মানুষ এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত নিন্দা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সংগঠিত প্রতিরোধ। প্রয়োজন আসলে আন্দোলনেরই। আর সে আন্দোলনের পরিধি শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধতা করায় সীমাবদ্ধ রাখা মোটেই যথেষ্ট হবে না। আন্দোলন দরকার গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই।

ক্ষমতায় যারা আসা-যাওয়া করে সেই বড় দুই দল ও তাদের সঙ্গীরা অমানবিক ওই ব্যবস্থারই সংরক্ষক ও সুবিধাভোগী। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে বিযুক্ত হয়ে যাঁরা তথাকথিত তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করতে চাইছেন, তাঁরাও দেশের শাসক শ্রেণিরই অংশ বটে, যাদের কাছ থেকে দেশবাসীর পক্ষে নিরাপত্তাহীনতা ভিন্ন অন্য বিশেষ কিছু আশা করার যে নেই– তা এরই মধ্যে প্রমাণিত।

ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন সমাজ ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার আন্দোলনেরই অপর নাম। এই আন্দোলন যেমন হতে হবে রাজনৈতিক, তেমনি সাংস্কৃতিকও। দুঃখের বিষয়, দুই বড় দলের রাজনীতি অন্যদের তো বটেই, সংস্কৃতিকর্মীদেরও দলীয়ভাবে বিভক্ত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেষ্ট। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও জোট শাসক শ্রেণির দলীয় অঙ্গ সংগঠন ও জোটে পরিণত হয়ে পড়েছে। পরিবর্তনের আন্দোলন ওই দুই দলের বাইরের অবস্থানে দাঁড়িয়েই করতে হবে; অন্যভাবে করার কোনো উপায় নেই।

আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে মোটেই ভালো নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটাও অবশ্য সত্য যে, অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে মন্দ মনে হচ্ছে কয়েকটি অতিরিক্ত কারণে।

প্রথমত, মানুষ আশা করেছে অবস্থার উন্নতি হবে। শুধু আশা করেনি; উন্নতির জন্য শ্রম দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। অংশ নিয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার পরিবর্তনের সংগ্রামে। মানুষ এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক ক্ষুব্ধ। যে কারণে বর্তমানের মন্দদশা তাদের কাছে বিশেষভাবে অসহ্য ঠেকছে। দ্বিতীয়ত, সমাজে নির্লজ্জতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে একদা এক স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছিল। আমরা তাঁর নাম দিয়েছিলাম বিশ্ববেহায়া। কিন্তু রাজনীতিতে বেহায়াপনা মোটেই কমেনি। কিন্তু আমরা ওই নির্লজ্জতা সহ্য করছি, হয়তো উপভোগও করছি এবং সে বিষয়ে খবর পড়তে বাধ্য হচ্ছি। বোঝা যাচ্ছে, রাজনৈতিক বেহায়াপনাকে ধিক্কার দেওয়া, ধমক দেওয়ার শক্তি সমাজে এখন নেই। এও এক করুণ নিম্নগমন বটে। তৃতীয়ত, সমাজের সর্বত্র নৃশংসতা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটত। কিন্তু হত্যা করে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে ফেলার ঘটনা সহিংসতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সংযোজন বটে। এটি ভেতরের মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।

পরিস্থিতি এগোচ্ছে অরাজকতার দিকে। সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক নৈরাশ্য। মানুষ সমাজে বাস করে। সেখানে আজ কোনো নিরাপত্তা নেই। না আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না দৈহিক। রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন করতে পারছে না। উপরন্তু সে নিজেই একটি সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তার পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ– কেউ নিরাপত্তা দেয় না, বরং মানুষের জন্য ভীতির কারণ হয়। অন্যদিকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস ঘটছে রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য, আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায়। সন্ত্রাসীদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না।
এ পরিস্থিতিতে আমরা যারা সাধারণ মানুষ; যাদের ভেতর রয়েছে দেশপ্রেম ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, তাঁরা কী করতে পারি? স্বভাবতই প্রথম কাজ শত্রু কে– সেটা নিরূপণ করা। শত্রু হচ্ছে সেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, যা বিত্তবানদের নির্মম ও অরাজক শাসনকে স্থায়ী করে রেখেছে। সংগত কারণেই শত্রু তারাও, এই ব্যবস্থার যারা রক্ষক ও বিশেষ সুবিধাভোগী। আঘাত করতে হবে সেখানেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: [email protected]

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া