সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা কুয়াকাটা
|
জিল্লুর রহমান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব ও এর সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর ২৭ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রতিবছর দিবসটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে যে কটি পর্যটন স্পট রয়েছে তার মধ্যে সাগরকন্যা কুয়াকাটা একটি এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে নিঃসন্দেহে এর গুরুত্ব ও সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। আসলে মানুষ মাত্রই প্রকৃতির পূজারি। প্রাকৃতিক আকর্ষণগুলো মানুষকে বরাবরই টানে। প্রকৃতিকে ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জীবন যেখানে বৈচিত্র্যময়, প্রকৃতি যেখানে মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সমুদ্রের গর্জন যেখানে মানুষকে আবেগাপ্লুত করে, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের লুকোচুরি যেখানে মানুষকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। এমনই একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানের নাম কুয়াকাটা। পর্যটকদের কাছে কুয়াকাটা ‘সাগরকন্যা’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় দর্শনীয় স্থানটির অবস্থান। এটি একাধারে সমুদ্রসৈকত ও পর্যটনকেন্দ্র। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সৈকত বিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্রসৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। কুয়াকাটা মূলত পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব ৩৮০ কিলোমিটার, বরিশাল থেকে ১০৮ কিলোমিটার ও পটুয়াখালী থেকে ৮৪ কিলোমিটার। সড়ক, নৌ ও আকাশ পথ তিনটি মাধ্যমেই কুয়াকাটা পৌঁছানো যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বেশ কয়েকটি বাস সকাল ও সন্ধ্যায় এখন সরাসরি কুয়াকাটা যায়। এসব বাস কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে নামিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা বাসে যেতে মোট সময় লাগে প্রায় ৮/১০ ঘণ্টা। বর্তমানে দুটি ফেরি পার হতে হয়। পদ্মা সেতু ও লেবুখালী সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ৫/৬ ঘণ্টায় কুয়াকাটা পৌঁছানো সম্ভব হবে। লেবুখালী সেতুর কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং খুব শীঘ্রই পারাপারের জন্য খুলে দেওয়া হবে। নৌপথে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী বা আমতলী হয়ে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। লঞ্চ এক্ষেত্রে অনেক ভালো ও আরামদায়ক একটা বিকল্প। ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকাল ৪.৩০টার মধ্যে আমতলীর লঞ্চ, বিকাল ৫.৩০ থেকে ৬.৩০টার মধ্যে পটুয়াখালীর লঞ্চ এবং রাত ৮.৩০ থেকে ৯.০০টার মধ্যে বরিশালের লঞ্চ ছেড়ে যায় এবং ফজরের নামাজের ওয়াক্তের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। আরামদায়ক লঞ্চের কেবিন সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ। কুয়াকাটায় পর্যটকদের থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল-মোটেল আছে। পর্যটন করপোরেশনের আছে ইয়ুথ ইন কুয়াকাটা ও হলিডে হোম। এছাড়া সচ্ছলদের জন্য আছে সিকদার রিসোর্ট। দীর্ঘ বন্ধের ছুটিতে বেড়াতে গেলে ১০/১৫ দিন আগে হোটেল বুকিং দিয়ে বেড়াতে যাওয়া ভালো, অন্যথায় অনেক সময় মানসম্মত হোটেল পাওয়া যায় না এবং ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে খুব সহজে সব হোটেলে যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে দেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালী জেলায় কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। আশির দশক থেকে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণাঞ্চলের এই জায়গার কদর বাড়তে থাকে। তখন থেকে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপ্রেমীরা আসতে শুরু করেন। এখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হন তারা। ধীরে ধীরে পর্যটকদের মনে জায়গা করে নেয় এই সৈকত। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় কুয়াকাটায়। এছাড়া এখানে রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ ও তাদের ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার। কুয়াকাটা নামের পেছনে রয়েছে আরকানদের এদেশে আগমনের সঙ্গে জড়িত ইতিহাস। ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে মূলত ‘কুপ’ থেকে। ধারণা করা হয় ১৮ শতকে মোঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখন এখানে সুপেয় জলের অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কুপ খনন করেছিলেন, সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা! সেই কুয়া খনন থেকে আজকের ‘কুয়াকাটা’ নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। জিরো পয়েন্টের কাছে এমন একটি কুয়া এখনো টিকে আছে। তবে, প্রবীণ জয়নাল খাঁ (৯৭) নামে এক সময়কার ব্রিটিশ সেনা সদস্যের তথ্য মতে, এখানকার প্রথম আদিবাসী পাড়া-প্রধান কুয়াসা মংয়ের নামে ‘কুয়াকাটা’ নামকরণ করা হয়েছে। তবে যাই হোক, কবে কখন কুয়াকাটা নামকরণ করা হয়েছে তা আজও সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২২৫ বছর আগে বার্মার আরাকানে জাতিগত কোন্দলের কারণে রাতের আঁধারে রাখাইন সম্প্রদায়ের ১৫০টি পরিবার ৫০টি কাঠের নৌকাযোগে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। দীর্ঘ সাতদিন নৌকায় থেকে বসবাসের জন্য প্রথমে কক্সবাজার, পরে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রাঙ্গাবালী, মৌডুবী এবং সর্বশেষে কুয়াকাটায় আসে। কুয়াকাটা তখন ছিল গহীন বনাঞ্চল। বসবাসের জন্য রাখাইনরা ঘাটলা (বর্তমান কুয়াকাটা) নামের অঞ্চলটিকে বেছে নেয়। বন্য হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বন আবাদ করে বসবাস শুরু করে। এ অঞ্চলে বসবাসে সবকিছু অনুকূলে থাকলেও সংকট দেখা দেয় খাবার পানির। এ সময় অঞ্জলি পরিবারের লোকজন কুয়া (কুপ) খনন করে মিষ্টি পানির সন্ধান পায়। রাখাইনরা এ স্থানের নাম দেয় ক্যাঁচাই (ভাগ্য গড়ার স্থান)। এর আগে ব্রিটিশদের ঘাট থাকায় এর নাম ছিল ঘাটলা। কিন্তু বাঙালিরা এসে রাখাইনদের কুয়াকে কেন্দ্র করে এই স্থানের নামকরণ করে কুয়াকাটা। একে পর্যটকরা সাগরকন্যা বলে থাকলেও এর কোনো ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই। তবে কক্সবাজারের ইনানি বিচকেও অনেকে সাগরকন্যা বলে থাকে। পটুয়াখালী জেলাকেও বলা হয় সাগরকন্যা। আর দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও এই নামেই কুয়াকাটাকে চেনে। তবে পৌরাণিকে সাগরের দেবতা হচ্ছে পসাইডন এবং তার কন্যা এম্ফিত্রিতিকে বলা হতো সাগরকন্যা। ১৯৯৮ সালের মে মাসে কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালে পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে কুয়াকাটা। কিন্তু এখানে কোনো বাস টার্মিনাল নেই। তাই বাসগুলো কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে টিঅ্যান্ডটি ভবন পর্যন্ত রাস্তার মাঝখানেই রাখা হয়। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়েন পর্যটকরা। কুয়াকাটার সন্নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে ফাতরার বন, কুয়াকাটার ‘কুয়া’, সীমা বৌদ্ধ মন্দির, কেরানিপাড়া, আলীপুর বন্দর, মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, গঙ্গামতির জঙ্গল, চর বিজয় ইত্যাদি। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা ‘চর বিজয়’। প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটিতে এখনো কোনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি, কিংবা নেই কোনো গাছপালা। বর্ষার ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে চরটি। আবার শীতের মৌসুমে ধু ধু বালুচর। জনবসতিহীন দ্বীপজুড়েই লাল কাঁকড়া ও নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম। কুয়াকাটা থেকে ট্যুরিস্ট বোটে চর বিজয় যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এ সময় পর্যটকগণ উপভোগ করতে পারবেন সমুদ্রের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ জলরাশি ও সমুদ্রের বিশালতা ভ্রমণে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। দ্বীপটির কাছাকাছি গেলেই স্বাগত জানাবে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। বোট থেকে নামলেই লাল গালিচা সংবর্ধনা জানাবে লাল কাঁকড়ায় জড়ানো দ্বীপ। দ্বীপের স্বচ্ছ জলে সামুদ্রিক মাছের ছোটাছুটি নিমেষেই আপনার সারাদিনের ক্লান্ত মনকে ভরিয়ে দেবে অন্যরকম আনন্দে। তবে এ দ্বীপে কোনো দোকানপাট নেই, তাই কুয়াকাটা থেকেই খাবার ও পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসা যায়। বিজয়ের মাসে নতুন এ চরের সন্ধান মেলায় ভ্রমণপ্রেমিকরা এটিকে ‘চর বিজয়’ নামে আখ্যায়িত করেন। তবে সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নামের স্বীকৃতি দেয়নি। চর বিজয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে শিক্ষার্থীরা ও টাঙানো সাইনবোর্ডই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে চরটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে ও নিরাপদ ভ্রমণের সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসন, কুয়াকাটা পৌর প্রশাসন, বন বিভাগ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌপুলিশ, হোটেল মালিক সমিতি, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী এবং পরিবেশ সংগঠন ও সাংবাদিকদের প্রতিনিধি, পর্যটন ব্যবসায়ীরাসহ বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন চরটি পরিদর্শন করে। বন বিভাগের উদ্যোগে বাগান সৃজনে রোপণ করা হয় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির প্রায় দুই হাজার গোল, ছইলা, কেওড়া ও সুন্দরী গাছের চারা। যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা ওড়ানো ও সরকারের পক্ষে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ‘চর বিজয়’ অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনস্থল। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন বিজয়ের নামাঙ্কিত অপরূপ চরটিতে। কুয়াকাটার কাছেই সুন্দরবন আরেকটি আকর্ষণীয় ভ্রমণ স্পট। তবে ট্রলারযোগে এ যাত্রাপথ বেশ দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ। কুয়াকাটা থেকে যদি সুন্দরবন যাওয়ার আরামদায়ক নৌভ্রমণের সুব্যবস্থা থাকত, তাহলে পর্যটক সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেত বলে অভিমত স্থানীয় অনেকের। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হতেন, তেমনই সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেত। পায়রা সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি সামুদ্রিক বন্দর। এটি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ও বালিয়াতলী সংলগ্ন রাবনাবাদ চ্যানেল ও সংলগ্ন আন্ধারমানিক নদী তীরবর্তী টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া স্থানে অবস্থিত। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে এর ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। আগস্ট ১৩, ২০১৬ সালে সমুদ্র বন্দরটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রায় ৬০০০ একর জায়গায় এটি গড়ে উঠেছে যেখানে বিশাল অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এটিও ধীরে ধীরে পর্যটকদের কাছে সম্ভাবনাময় আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে মালদ্বীপের মতো পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাজধানীর সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ যথাযথ উদ্যোগ। পদ্মা সেতু চালু হলে সেই সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এদিকে, দ্রুত এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ৬ ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। এলাকায় বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশ কিছু দ্বীপ আছে সেগুলোর সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। এজন্য ইতোমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালী ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখনকার প্রধান দুটি আকর্ষণীয় স্থান লাল কাঁকড়ার চর এবং অতিথি পাখির অভয়ারণ্য চর বিজয়। কুয়াকাটার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে বাইক, ভ্যান, নৌকা বা ট্রলার ব্যবহার করতে হয়। তবে সমুদ্রসৈকতে বাইক নিয়ে ঘুরলে আলাদা অনুভূতি পাওয়া সম্ভব। এতে সময় বেঁচে যাবে একই সঙ্গে অনেক জায়গা ঘুরে দেখা যাবে। তবে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই প্রাইভেট কার নিয়ে ঘুরতে আসেন। কিন্তু গাড়ি নিয়ে স্পট পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই সড়কগুলোর উন্নয়ন প্রয়োজন। অবকাঠামোর পর্যাপ্ত উন্নয়ন ও বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার কুয়াকাটায়। তাহলে পর্যটকরা আরও আকৃষ্ট হবে। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটায় ছিল ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। যেখানে দেখা যেত বিভিন্ন প্রজাতির শত শত গাছ। পাখির অভয়াশ্রম এই বাগানে ছিল বন্য শিয়াল, বানর ও অন্যান্য প্রাণী। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত গোটা স্থান। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের অব্যাহত ভাঙনে সেই ফয়েজ মিয়ার বাগান বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। অবশ্য কুয়াকাটায় বাঁধ রক্ষার কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সাগরকন্যা ভালো নেই। পর্যটক সমাগম বাড়াতে এগুলোর নিরসন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা মনে করেন, উন্নত নগরীতে গড়ে তুললে কুয়াকাটায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাড়বে, একইসঙ্গে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এখানে বছরে তিন থেকে পাঁচ লাখের বেশি পর্যটক সাগরকন্যা কুয়াকাটা দেখতে আসে। বর্তমান সরকার কুয়াকাটাকে পর্যটনবান্ধব করার লক্ষ্যে যেসকল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হলে পর্যটকদের সংখ্যা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ সরকার, ট্যুরিস্ট পুলিশ, টোয়াকসহ স্থানীয় পর্যটন সংস্থাগুলো পর্যটন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, পর্যটকদের নিরাপত্তা, মানসম্মত হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পর্যটকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, ট্যুরিস্ট গাইডসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে। এতে পর্যটকসহ স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা উভয়ে উপকৃত হবে। এসব বিষয় বাস্তবায়ন সম্ভব হলে কুয়াকাটা হবে মডেল পর্যটন কেন্দ্র। সাগরকন্যা কুয়াকাটাকে সম্ভাবনা থেকে সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্থানীয়দের পর্যটনবান্ধব আচরণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ পরিচালনার প্রয়োজনীয় নীতিমালা, ট্যুরিস্ট পুুলিশের সহযোগিতা, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, দক্ষ গাইড, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, স্থানীয় পরিবহন সংস্থাগুলোর পর্যটনবান্ধব আচরণ ও সহযোগিতা। পর্যটনের মাধ্যমে মানুষ স্বাবলম্বী হবে, স্থানীয় লোকজন উপকৃত হবে, বেকার সংখ্যা কমে যাবে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। পর্যটন শুধু আকর্ষণীয় স্থানের ওপর নির্ভর করে না। সঙ্গে ওই পর্যটন স্পটকে কেন্দ্র করে যে ভৌত কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সেটিও বেশ জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুন্নত অবকাঠামো, পর্যটন স্পটগুলোকে বিশ্বমানে রূপান্তর না করা, স্পটসংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি না করা, সাংস্কৃতিক আয়োজন না থাকা, পরিচালনে রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব ও সর্বোপরি সরকারের সুনজর না থাকায় পর্যটনের কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটছে না। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত চিত্তবিনোদনের একটি পার্ক নির্মাণ, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে বিভিন্ন স্পট পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সৈকতে সিসি ক্যামেরা যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয়রা। সরকারের উদ্যোগে কুয়াকাটার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠবে কুয়াকাটা। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পাশাপাশি এখানে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে আশার কথা হলো, অতি সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ আশপাশের এলাকাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য। সকলে চায়, সরকার দ্রুত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করুক। পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সে আশা পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকলের। জিল্লুর রহমান : ব্যাংকার; গেণ্ডারিয়া, ঢাকা |