আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই যোগাযোগমাধ্যমেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তারই কল্যাণে চাইলেই আমরা দেশের বাইরের সব খবর পেয়ে যাই মুহূর্তেই। এক্ষেত্রে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের জুড়ি নেই। শুধু খবর পেয়েই ক্ষান্ত নই, নিজেদের মন্তব্যের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যুক্তও হতে পারি।
অন্তত আমাদের দেশে ফেসবুক হয়ে উঠেছে নিজেদের রোজকার প্রতিমুহূর্তের ঘটনা প্রচার করার রঙ্গমঞ্চ। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সদ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া পাওয়া ব্যক্তিটিও বাদ নেই। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যা যা করা হয়, তা ফেসবুকে আপলোড না করলে যেন দিনটাই পরিপূর্ণতা পায় না। নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সব বিষয় ফেসবুকে না জানাতে পারলে অনেকটাই পিছিয়ে গেলাম বলে মনে করি। আমরা সংসার ও ব্যক্তিগত জীবনের সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে আসি যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দেওয়ার মাধ্যমে। নিজেদের এত বুদ্ধিমান ভাবা সত্ত্বেও একবারের জন্যও প্রশ্ন করি না যাদের কাছে সমাধান চাইছি, তারা কি আমার সমস্যার সমাধান করার যোগ্য? এমন অনেক বিষয় শেয়ার করা হয়ে থাকে, যা হয়তো ব্যক্তিগত রাখাটাই সমীচীন, যা আমরা আমলে নিই না। ফলস্বরূপ পেতে হয় অজস্র কুরুচিকর মন্তব্য।
ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এখনকার শিশু-কিশোর-কিশোরীরাও মেতে উঠেছে এই প্রতিযোগিতায়। নিজেদের প্রাত্যহিক রুটিন মানুষকে জানান দেওয়াই তাদের অন্যতম কাজ। তা আসলেই মানুষের উপকার বয়ে আনছে কি না, তা ভাবার সময় কোথায়? এর থেকেও মারাত্মক ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, আমাদের শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা যখন অপ্রয়োজনীয় ভিডিও শেয়ার করে শুধু লাইক, কমেন্ট পাওয়ার আশায়, সেখানে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কতটা করে থাকে, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একইভাবে যে কোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্যের মাধ্যমে ট্রল করাটাও হয়ে উঠেছে সভ্য সমাজের মানদণ্ড। আমরা স্বাধীনচেতা মনোভাব পোষণ করি, তাই কেউ ভুল করলে ছাড় দিতে রাজি নই। যেটা বলা যায় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অন্যের সুখ-দুঃখে মন্তব্যের মাধ্যমে শামিল হওয়াটা যদি সেই ব্যক্তির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলত, তবে বোধ হয় কোনো সমস্যার উদ্ভব হতো না। কিন্তু আমাদের এমন চিত্র খুবই কম দেখার সৌভাগ্য হয়ে থাকে। আমরা নিজেদের জ্ঞানের পরিসীমা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। তাই সব বিষয়ে পারদর্শী ও পরিপূর্ণ—এমন একটা মনোভাব নিয়ে মানুষকে জ্ঞান দিই। ছাড় দেওয়ার প্রবণতা আমাদের নেই বললেই চলে। মন্তব্য করতে দুই বার ভাবি না। নিজেদের নোংরা মানসিকতার শিকার করি অন্যদের। ফলে আত্মহত্যার মতো কাজের দিকেও মানুষ ঝুঁকে পড়ে। এর দায় কি মন্তব্যকারীদের ওপরে বর্তায় না? আমরা সবাই চাই সুস্থ একটা সমাজ, যেখানে আমরা ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থভাবে বিচরণ করব। অসুস্থ মানসিকতার শিকার হবে না। এমন সমাজ গড়ে তুলতে আমাদের একটু থামা প্রয়োজন। আমাদের কথা দ্বারা কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে কি না, তা উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা থাকা প্রয়োজন। আমরা মানুষ, মানুষমাত্রই সৃষ্টির সেরা অপরিপূর্ণ জীব। অপরিপূর্ণতাই আমাদের সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য আরো মহিমান্বিত হয়ে উঠবে, যখন আমরা একে অন্যের প্রতি সহনশীল হব। অন্যের গায়ের রং, আকৃতি, গড়ন, উচ্চতা, ব্যক্তিজীবন নিয়ে মন্তব্য করা নিম্নমানের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু না, আমরা মহত্ গুণাবলির অধিকারী। পৃথিবীকে দেওয়ার মতো অনেক কাজ আমাদের বাকি। মানুষ হিসেবে আমরা সৌন্দর্য, শুভ্রতা, নম্রতাকে লালন করি। তাই ভাবা উচিত, আমাদের মন্তব্য যেন অন্যের দুঃখের কারণ না হয়, বরং অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা, নতুন করে বাঁচার জীবনীশক্তি হিসেবে কাজ করে।