বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২), ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭) এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০) এই তিনটি খন্ডে রচিত এক মহাকাব্যিক আত্মকথা। এ সব আত্মকথা বা আত্মজীবনী সহজিয়া ভাষায় অনুপম বর্ণনা সাহিত্য-বিচারে একেকটি অমর কাব্যের তুল্য। এই প্রসঙ্গে আমরা বিশে^র মহৎ কিছু আত্মজৈবনিক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করতে পারি। রাজনীতিক ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিল তার বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ-বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে গ্রন্থিত আত্মজৈবনিক সঙ্কলনের জন্য ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী দি স্টোরি অব মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ বর্ণবৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনার নিরিখে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতবর্ষে মানবাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্যপট আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পটভূমি ও স্ব^প্নে ভরপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন খ-ের আত্মজীবনী আমাদেরকে সম্রাট বাবরের বাবুরনামার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু রচিত তিনখানি আত্মকথার বিস্তৃত সৈকতে মণি-মুক্তার মতোন ছড়িয়ে থাকা নানা ঘটনা ও চিন্তা-দর্শনের মূল ভিত্তি পরার্থে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা ও গভীর মমত্ববোধের ওপর স্থাপিত। এই গ্রন্থ তিনটিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবারিত সুযোগ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মকথায় তার মহাজীবনে অসহায়, অত্যাচারিত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কিছু ঘটনা বিশ্লেষণের চেষ্টা এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখা যায়, শেখ মুজিবের কৈশোরে তার পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ওপর বিরাট যৌথ সংসারের গুরুভার ও কষ্ট-কঠিন দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। চৌদ্দ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে এবং ষোলো বছর বয়সে চোখে গ্লুকোমা হলে চিকিৎসার জন্য তার পিতা তাকে দুবার কলকাতায় নিয়ে যান ও তাকে সুস্থ করে আনেন। ইতোমধ্যে সমাজের বৈষম্য ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর দলের অনুরাগী হয়ে পড়েন।
ইংরেজের হাত থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার শপথে শাণিত হন এবং প্রতিবাদী ও দরদী হৃদয় নিয়ে শেখ মুজিব সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু তার শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসির মুসলিম সেবা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং গরিব ছাত্রদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করেন (পৃঃ ৭-৯)। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন – ‘মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্ঠি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন (পৃঃ ৯)’।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় বাংলায় মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ হয়। ইংরেজ সরকার সৈন্যদের জন্য সমস্ত গুদামজাত খাদ্যদ্রব্য জব্দ করে। ব্যবসায়ীরা চাল-ডালসহ সকল খাদ্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই। কাপড় নাই।….. পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতে রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও। এই কথা বলতে বলতে ওই বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে (পৃঃ ১৭-১৮)।’
অসহায়-দুঃখী মানুষের কষ্টে ব্যথিত বঙ্গবন্ধুর এহেন হৃদয়বিদারক বর্ণনা আজও আমাদের মুহ্যমান করে তোলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার সিভিলমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তার ওপর দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার দায়িত্ব পড়েছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের জন্য ইংরেজদের খাদ্য মজুদের নির্দয়তা, অন্যদিকে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আহাজারি। এমন ভয়াবহ সময়ে মানবদরদী শেখ মুজিব পড়াশোনা বন্ধ রেখে দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষ বাঁচাতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- ‘এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনদিন বেকার হোস্টেলে আসতাম, কোনদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম’ (পৃঃ ১৮)।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট পাকিস্তানরাষ্ট্র বাস্তবায়নের দাবিতে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষিত ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ পালন করতে গেলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। হত্যা, লুটতরাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণে কলকাতা নরকে পরিণত হয়। সেই সময় তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দাঙ্গায় আক্রান্ত উভয় ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে গেছেন। বর্ধমানের আসানসোলে ও বিহারের পাটনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। রাত জেগে বন্দুক হাতে কলকাতার মুসলমান বস্তি পাহারা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের গরিব-দিনমজুররা ধান ওঠার মৌসুমে দল বেঁধে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ধানকাটার কাজ করতে যেত; এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। যেমন- ঢাকা ও ফরিদপুরের দাওয়ালরা খুলনা ও বরিশাল জেলায় এবং কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় ধান কাটতে যেত। এই গরিব-দিনমজুররা ধান কেটে গৃহস্থের ঘরে উঠিয়ে দিত এবং বিনিময়ে ধানের একটা অংশ পেত।
একবার পূর্ব বাংলার কিছু জেলায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার কর্ডন প্রথা চালু করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য আনা-নেয়া বন্ধ করে দেয়। পরিণতিতে, বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য- ‘এরা প্রায় সকলেই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেত হতো। যাবার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার শোধ করত।…. এই লোকগুলো দিনমজুর। দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরি তাদের মিলল না। আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধার করে এনেছিল, এই দুই মাসের খরচের জন্য খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটাবাড়িও ছাড়তে হলো’ (পৃঃ ১০৩-১০৪)।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগবিধি, সুযোগ-সুবিধা ও চাকরির নিশ্চয়তা কিছুই ছিল না। ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ দাবি-দাওয়া আদায়ের কোন উপায়ান্তর না দেখে তারা ধর্মঘট পালন করেন। বিশ^বিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান ও আন্দোলনে সমর্থন দেন। কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ৫ মার্চ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় (পৃঃ ৪৬)। এই ঘটনায় ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বঙ্গবন্ধুসহ আন্দোলনে অংশ নেয়া ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বহিষ্কার, জরিমানা, জরিমানাসহ মুচলেকা, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট, ছাত্রবৃত্তি বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করল।
অধিকাংশ শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেন। কর্মচারীদেরও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা কাজে যোগ দেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান মাথা নত করেন নাই। তিনি জরিমানা ও মুচলেকা দেন নাই। ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের জন্য কোন আবেদনও করেন নাই। ফলে ১৯৪৯ সালে ১৭ এপ্রিল তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। সহজ কথায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।
কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)
বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খ- কারাগারের রোজনামচায় অসহায়, অবহেলিত ও সমাজের নিচুতলার মানুষের দুঃখ-কষ্টে কিভাবে ব্যথিত হয়েছেন; বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা দরিদ্র মানুষের স্ত্রী-পরিজনদের দুঃশ্চিন্তায় ক্ষুব্ধ হয়েছেনÑ তা পড়লে তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে; দু’চোখ জলে ভরে যায়। এখানে কারাগারের রোজনামচা থেকে দু’-একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
তিনি বইপত্র ও পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি কারাগারে দিনের পর দিন কয়েদিদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী শুনেছেন। এদের কাহিনীগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ ধারণা গ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধু লুৎফর রহমান ওরফে লুদু নামে এক পকেটমারের জীবন-কাহিনী বর্ণনা করেছেন আট পাতাজুড়ে। বঙ্গবন্ধু দেখেছেন, ফরিদপুর কারাগারে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হতো। এই অমানবিকতা বঙ্গবন্ধুকে ব্যথিত ও বিচলিত করে তোলে। তিনি কারাগারে এহেন কষ্টকর কাজ বন্ধ করার জন্য জেলারকে বলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন। প্রায় ৮০০ জন সাধারণ নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় (পৃঃ ৭৫-৭৬)। এই দরিদ্র-সাধারণ মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে। কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন- ‘যাদের ধরে নিয়ে এসেছে এরা গরিব, দিনমজুরি না করলে বাঁচতে পারবে না। অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলে-মেয়ে না খেয়েই আছে। …এমন অনেক লোক (কারাগারে) আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দীর স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়’ (পৃঃ ৯৪)।
আমার দেখা নয়াচীন
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে ১৯৫২ সালে চীনের বেজিংয়ে বিশ^ শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯৫৪ সালে কারাবন্দী অবস্থায় তার এই তৃতীয় আত্মজীবনী ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০) রচনা করেন। এক নাগাড়ে ২৫ দিনের চীন ভ্রমণের হৃদয় উৎসারিত অবলোকন ও পর্যবেক্ষণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা এই গ্রন্থ। এইভাবে পিকিং (বর্তমানে বেজিং), তিয়ানজিং, নানকিং, ক্যান্টন, সাংহাই ও হ্যাংচো শহরে ঘুরেছেন। দোকান-পাট, শিল্প-কারখানা, কৃষি খামার, চাষাবাদ, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও হাসপাতাল দেখেছেন। বিশেষত, দরিদ্র-অসহায় মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনা দেখার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে তার দরদী কলমে।
‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়লে মানুষের বাক-স্বাধীনতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থন প্রশংসনীয়। গ্রন্থের সর্বশেষ প্যারায় সেই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট এবং জোরাল হয়েছে তার অসাধারণ সারল্য ও অনুপম ভাষা কুশলতায়- ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়’ (পৃঃ ১১৯)। অন্যদিকে, আশৈশব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নয়াচীনের শ্রমিকদের উন্নত জীবনযাপনে কি-যে খুশি হয়েছিলেন, তার ভাষাতেই আমাদের তা অনুভব করা বাঞ্ছনীয়- ‘আমরা দেখে আনন্দিত হলাম, মেয়ে শ্রমিকরা যখন কাজে যায়, তখন তাদের ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য মিলের সাথে নার্সিং হোম আছে। কাজে যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়েদের সেখানে দিয়ে যায়। ….শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতাল আছে। অসুস্থতার সময় বেতনসহ ছুটি দেওয়া হয়। …দুপুর বেলা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি, শ্রমিকদের জন্য যে কলোনী করা হয়েছে, তা দেখার জন্য। দু’মাইল লম্বা বিরাট কলোনী করা হয়েছে, আরও অনেকগুলি হচ্ছে। তার মধ্যে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করা হয়েছে’ (পৃঃ ৭০-৭১)।
চীনের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, ঘুরে ঘুরে, পিকিং থেকে হংকং পর্যন্ত ট্রেনযাত্রার সময় গ্রাম-গঞ্জ-শহর দেখে একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ চিয়াং কাইশেকের আমলের কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের কথা বিবৃত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সে প্রসঙ্গে নিজের দেশের জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনীও উল্লেখ করতে ভোলেন নাই। বাংলার দুঃখী মানুষের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আবার চীনের নতুন সরকারের কৃষি ব্যবস্থার কথা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। তার লেখার ভাষ্য এ রকম- ‘চিয়াং কাইশেকের আমলে জমির মালিক জমিদারই ছিল। চাষীর জমির ওপর কোন অধিকার ছিল না। চাষীরা ক্ষেতমজুরি করে কোনমতে জীবনযাপন করত। …চাষীরা জমির অধিকার চাইলে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হতো।…ধরে এনে বেত মারত। না খাওয়াইয়া আটকাইয়া রাখত। আমাদের দেশেও পূর্বে এই ব্যবস্থা ছিল। যদি কোন কৃষকের মেয়ে দেখতে ভাল হতো, তবে তো আর উপায় ছিল না। জমিদারের হুকুম তাকে জমিদারের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে হবে, খাজনার পরিবর্তে। ….যদি কোন মেয়ের বাবা-মা আপত্তি করে, তবে তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হবে এবং অমানুষিক অত্যাচার করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে’ (পৃঃ ৮৭-৮৮)।
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ বঙ্গবন্ধু চীনের সমাজের বৈষম্য, নিপীড়িন ও অভাবের কারণে সে দেশের মানুষের কমিউনিস্ট পার্টির পথ অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছেন। এ যেন বাঙালীর বাঁচার দাবি ৬ দফার পথ ধরে মুক্তির পথে এগিয়ে চলার কথা। তাই ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২৮ অক্টোবর রেডিও-টেলিভিশনের ঐতিহাসিক ভাষণে- ‘মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চিরঅবসান ঘটিয়ে শোষণমুক্ত এক সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার এবং অন্যায়-অবিচার বিদূরিত করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার’ শপথ আমাদের বাঙালীর মুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আজীবনের স্বপ্ন ছিল অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। শৈশব-কৈশোর থেকেই অসহায়, দরিদ্র, বিপন্ন ও সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবতার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বর্ণিত সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণ শেখ মুজিবের মানবতার সেবা আমাদের শাণিত ও প্রাণিত করে। তাই হয়তো বিশে^র নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা ও রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আদলে তার রাজনৈতিক দর্শনে, চিন্তায় ও শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বাকশাল কায়েম করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ …আমরা চেয়েছি একটি শোষণমুক্ত সমাজ, আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, আমরা চেয়েছিলাম এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য।’ এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানবতার সেবায় উৎসর্গিত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি। জীবনের পথে পথে, জেল-জুলুম-নির্যাতনে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, আনন্দ-বেদনায় তার সংগ্রাম ও সাফল্যের পেছনে রয়েছে আন্তরিক সত্যতা, অসম সাহস, দুর্দমনীয় কর্মনিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীগুলো পড়তে পড়তে ইতিহাসবিদ, রাজনীতির গবেষক, এমন কি সাধারণ পাঠকেরও বারবার মনে হবে রবীন্দ্র্রনাথের কবিতার অমর পঙক্তি- ‘চিনিলাম আপনারে/আঘাতে আঘাতে/বেদনায় বেদনায়;/সত্য যে কঠিন,/কঠিনেরে ভালোবসিলাম/সে কখনো করে না বঞ্চনা’। তাই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী এবং বাঙালী জাতির পিতা।