ভূমিকা
প্রযুক্তি এক সময় মানুষের কাছে একটি শখের বস্তু ছিল। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি মানুষের কাছে প্রয়োজন বা চাহিদা হয়ে উঠেছে। আধুনিকতা, বাস্তবতা এবং প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করেই এগিয়ে চলছে।বিগত দুই বছরে করোনা মহামারির বাস্তবতায় মানুষ অতিমাত্রায় প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়েছে। মানুষ প্রযুক্তিমুখী হয়েছে। আর এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণেই দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারও বেড়েছে। স্কুলের পড়াশোনা থেকে শুরু করে হোম অফিস, বাড়িতে বসে কেনাকাটা সবকিছুই প্রযুক্তির মাধ্যমেই প্রসার পেয়েছে।
নতুন স্বাভাবিক জীবনেও আমরা এভাবেই নিজেদের অভ্যস্ত করে ফেলেছি। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু এর অতি ব্যবহারে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়। ফলে এই আশীর্বাদ যেন অভিশাপে পরিণত না হয় সে বিষয়েও আমাদের নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার আমাদের আরো বেশি সামাজিক করার পরিবর্তে অসামাজিক করে তুলছে প্রতিনিয়ত।ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ।
বিজ্ঞাপন
আর এই চাপ আমাদের নানান ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আসক্তির কারণ
বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ এবং সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারীর দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান দশম স্থানে। যার মধ্যে ইউনিক মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা আনুমানিক ১০ কোটি অর্থাৎ প্রতি দুইজন মোবাইল গ্রাহকের বিপরীতে একজন গ্রাহক ফেসবুক ব্যবহার করে। এবং বাংলাদেশে মোট মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৭ হাজার।সর্বশেষ ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আমরা কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলতে শুধু ফেসবুককেই মনে করে থাকি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে- facebook, messanger, google, instagram, linkedln, pinterest, tumbler, snapchat, twitter, viber, wechat, whatsApp, youtube ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অগ্রপথিক হচ্ছে facebook.
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী হিসাবে দেখা যায়, পুরুষরা এখনও নারীদের চেয়ে এই মাধ্যম ব্যবহারে এগিয়ে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। করোনা মহামারির বাস্তবতায় নারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ সময়ে করোনার কারণে এফ কমার্সের প্রসার হয়েছে বেশি। যার বড় অংশের উদ্যোক্তা নারী। শহর থেকে গ্রাম, সব জায়গাতেই নারীরা এখন অনেক ধরনের অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় এই সংখ্যা বেড়েছে। তবে, এখনো পুরুষ ব্যবহারকারীর তুলনায় নারীর অবস্থান অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে নারীরা সবেচয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগও নারীর কম। তবে সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা।
মহামারি বাস্তবতায় এই মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংযোজন হয়েছে স্কুলের বাচ্চাদের। মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষার ঘাটতি পূরণে অনলাইন ক্লাসের সুযোগ রাখা হয়। ফলে প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব চলে এসেছে শিশু, কিশোর সকলের একেবারে নাগালের মধ্যে।
মাদকের চেয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আসক্তি মহামারি আকারে বাড়ছে । এর সঠিক ব্যবহার বা সীমা আমরা ঠিক করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে, সারাদিন প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে করে অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভিডিও , সংবাদ, বন্ধুদের সাথে রাত জেগে চ্যাটিং বেড়ে যাচ্ছে। নেশার মতন ছেয়ে ফেলছে আমাদের। একটা অজানা বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ খুবই সহজাত। তাই প্রযুক্তি বিষয়ে শিশু কিশোরদেরকে এক সময় বাধা নিষেধের মধ্যে রাখা হলেও মহামারি বাস্তবতায় অভিভাবকেরা সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিতে বাধ্য হন। তবে অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী ফলে, সারাদিন তাদের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে সন্তানের সাথে থাকা সম্ভব হয় না। এজন্য সন্তানের প্রতি নজরদারির বিষয়টিও অনেক সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ধরনের বন্ধন ছিল, এখন তা নেই৷ যে যার মতো চলছে । আগে বাবা-মা, ভাই-বোনের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক ছিল, এখন সেটা অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ যে ছেলেটি বা মেয়েটি সারাদিন ফেসবুক ব্যবহার করছে সে আসলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে সময় কাটাতে এই পথ বেছে নিয়েছে৷ পরিবারের সঙ্গে বন্ধন কমে যাওয়ার কারণে এই ধরনের মাধ্যমে তার যোগাযোগটি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে৷এই মাধ্যমগুলোর প্রবণতা হলো, যে কোনো একটি বিষয়ে নাম লিখে সার্চ দিলেই পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শ’ য়ে শ ‘ য়ে ভিডিও এসে ভরে যায়। এর সহজপ্রাপ্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যেমন ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধুদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করা যায় এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ থাকে না। নজরদারিও থাকে না। অল্প খরচে সহজ যোগাযোগ সম্ভব হয়। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরা মনে করে, অভিভাবকদের কারণে তাদের কৈশোর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকেরা পড়াশোনার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটে পড়ালেখার কাজও দেয়া হয়। কিন্তু বাবা মায়েরা বুঝতে চায় না।
আবার বাবা মায়েরা অভিযোগ করেন, সন্তানরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করার কারণে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক তৈরি হয়। এর ফলে সন্তানেরা তাদের হতাশা দূর করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেছে নিচ্ছে। যা কিনা পরবর্তীতে তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
আসক্তির ধরন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মূল যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ‘বিহেভিয়ার এডিকশন’ অর্থাৎ ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি৷ একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তখন চাইলেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না ৷ আর দীর্ঘসময় ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহারের ফলে অধিক সময় ব্যয় হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং যৌন আলাপচারিতা বেশি হয়। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিকারগ্রস্ত করে তোলে এবং বিপথে ঠেলে দেয়। যেমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৌর এলাকার আলীয়াবাদ গ্রামে মোবাইল ফোনে গেম খেলতে না দেয়ায় ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২সালে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন ইয়ামিন নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। তার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। সে পৌর এলাকার আলীয়াবাদ গ্রামে গোলাম মোস্তফার ছেলে ও নারায়ণপুর জাহেরা বেগম ইসলামীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা হেফজ বিভাগের ছাত্র। এছাড়াও ফোনে কথা বলতে গিয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ার ঘটনা, ফোনে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক থাকার কারণে বাড়ির ছাদ থেকে মৃত্যুর ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়।
ক্ষতিকর প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি বিভিন্নভাবে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। যেমনঃ
ক) সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে মানুষের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। একই ধরনের বিষয়ের মধ্যে ঘুরপাক খায় তাদের চিন্তা চেতনা। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিম। বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনো বিষয়ের গভীরে যেতে সক্ষম হয় না। আউট অব দ্য বক্স গিয়ে চিন্তা করার শক্তি লোপ পায়। এটি গ্রাস করে নিচ্ছে বাস্তবজগৎকে। পোস্ট , লাইক, শেয়ার, কমেন্টের মধ্যে জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
খ) কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়
সারাদিনের বেশির ভাগ সময় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করার ফলে অন্যান্য কাজের জন্য সময় নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় না।এটি এমন এক আসক্তি যে ক্রমশঃ চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। খুব সহজেই আমরা যা দেখতে চাই এবং দেখাতে চাই সব সম্ভব হয় ফলে একটি কমফোর্ট জোন তৈরি হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকে। এবং প্রতিটি সফল মানুষ সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে পারেন বলেই তিনি জীবনে সফল হোন সবক্ষেত্রেই। যে কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্তি সময় জ্ঞানকে নষ্ট করে। সময়ের মূল্য বোঝার ক্ষমতা নষ্ট হয় এতে।
গ) বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা ইদানীংকালে দেখি খুব সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়ে এবং নারীরা রাতারাতি বেশ পরিচিতি পাচ্ছেন। এবং অধিকাংশই যে যেই ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ করছেন সেটা নিয়ে আপাতঃ জীবনে অনেক ফ্যান ফলোয়ার তৈরি করছেন। এটি অত্যন্ত ভালো একটি দিক। নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। কিন্তু অপরদিকে এই একটি কাজেই নিজেকে আটকে ফেলছেন তারা। মেধা একটি জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছে। এক্সপার্টিজ ডেভেলপ করছে না। প্রতিটি জায়গায় মেধার বিকাশে নানান বিষয়ে জানতে হয়, কাজ করতে হয়। এক বিষয়ে এক নাগাড়ে বেশিদিন কাজ করলে একঘেয়েমি আসে। চিন্তার গভীরতা হ্রাস পায়। যা কিনা মেধার বিকাশে বাধা তৈরি করে। একই জায়গায় মেধা আটকে যায়। দক্ষতা তৈরি হয় না। আমরা ইদানীংকালে দেখি তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা টিকটক আসক্তিতে মেতে থাকছে। এর ফলে আমরা গ্যাং কালচার এর আবির্ভাবও দেখছি। আরেকটি গ্রুপ এসব দেখে দেখেই সময় কাটাচ্ছে। তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল আশংকাজনকহারে খারাপ হচ্ছে। ফলে না বুঝেই সুন্দর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
ঘ) শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
রাতদিন, সময়ে-অসময়ে ফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাডে বসে থাকার ফলে শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা দেয়। স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি হয়। ক্ষুধামন্দা তৈরি হয়। এক নাগাড়ে লম্বা সময় ঘাড় গুজে থাকার কারণে মেরুদণ্ডের নানান সমস্যা দেখা দেয়। একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের উপর চাপ পড়ে। ফলে মাথা ব্যাথা, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনাও দেখা যায়।
ঙ) মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তিকে মাদকের আসক্তির সাথে তুলনা করা হয়। এর ফলে সহজেই বোঝা যায় যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের আসক্তি কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এই আসক্তির কারণে শারীরিক ক্ষতির চেয়ে বেশি পরিমাণে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মানুষের চিন্তাশক্তি লোপ পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বেশিরভাগ জায়গাজুড়েই যেহেতু ফেসবুক রয়েছে এবং কৃত্রিম একটি জগৎ তৈরি করেছে ফলে এর নাম অনেকেই ফেসবুকের পরিবর্তে ফেইকবুক ও বলে থাকে। মানুষের মনোজগতটা অনেক জটিল একটি বিষয়।প্রতিনিয়ত এতে নানান ঘটনা ঘটতে থাকে। আর এই কৃত্রিমতা সেটাকে অনেকাংশেই তাড়িত করে। মানুষের মনোজগতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে। সুস্থ প্রতিযোগিতা এক সময় আসক্তির কারণে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিবর্তিত হয়। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, ফলাফল খারাপ হওয়া। এক সময় পরিবারের একটি চাপ তৈরি হওয়া এবং পরিবারের সাথে দুরত্ব তৈরি হওয়া। এসবের ফলে সব ক্ষেত্রেই একটি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। যা কিনা মানসিক রোগে পরিণত হয়। আর এই চাপ মাঝে মাঝে মাদকের পথেও নিয়ে যায়।
অন্যদিকে এসব মানসিক চাপের কারণে অনেকেই না বুঝে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা পরবর্তীতে অনেক বিপদের আশংকা সৃষ্টি করে। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ।
প্রতিকার / সমাধান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি তরুণ সমাজের জন্য অশনিসংকেত। ফলে সমস্যা যখন তৈরি হয়, তখন সমাধানের পথটিও পাশাপাশি তৈরি হতে থাকে। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির কারণে যে সব সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তার কিছু দিক নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে সমাধান খোঁজারও চেষ্টা করবো এবার ।
ক) পরিবারের দায়িত্ব
আমাদের পরিবারগুলো আগে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। যেখানে সবাই সবার সাথে মিলে মিশে থাকার একটি রেওয়াজ ছিল। যেখানে একজন আরেক জনকে সম্মান করা, অন্যের মতামতের মূল্য দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হতো। একজন আরেক জনের ভালো-মন্দে নজর দিতে পারতো। কিন্তু বর্তমান জীবনের চিত্র একটু ভিন্ন। সকলেই আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। অন্যের মতামত বা পরিবারের ভেল্যুজগুলো মনে রাখি না। যুগে যুগে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তন হচ্ছে। এক সাথে সকলে মিলে থাকার রেওয়াজ পাল্টিয়েছে। বাবা- মা, ছেলে -মেয়ে এই হলো পরিবার। আর এটাই এখন বড় বাস্তবতা। অধিকাংশ পরিবারে বাবা মা যেহেতু চাকরি করেন ফলে সন্তানেরা একা একাই বেশির ভাগ সময় কাটায়।তাদের এই একাকীত্ব থেকেই এক সময় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি তৈরি হয় । ফলে সন্তানের সাথে বাবামা’র বেশি সময় ব্যয় করার চেষ্টা করা উচিৎ এবং একটি গুণগত মান সম্পন্ন সময় কাটানোর চেষ্টা করা উচিৎ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা, মা, সন্তান সবাই এক সাথে বসে আছে, খাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সবার হাতে ছোট ডিভাইসটি এবং সকলেই তা নিয়ে ব্যাস্ত । আমরা সব সময় সন্তানের দোষ দেই। তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই উচিৎ অনুচিতের প্রশ্নে। কিন্তু আমরা পরিবারের বড়দেরও নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সকলকেই। ফ্যামিলি টাইম যেনো সত্যিকারের ফ্যমিলি টাইম হয় সে চেষ্টা করতে হবে। এতে করে সন্তানের সাথে বাবা-মা’র সুসম্পর্ক তৈরি হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে। ফলে সন্তানকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনের কথা বলার বা মন ভালো রাখার পথ খোঁজার প্রয়োজন পড়বে না। পরিবারের সহযোগিতা এখানে একান্ত প্রয়োজন। সন্তানকে শাসন করে নয়, তাদের বন্ধু হয়ে তাদের সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রতিটি সম্পর্কের গোড়াটাকে শক্ত করতে হবে।
খ) সমাজের দায়িত্ব
পরিবারের বাইরে সমাজেরও অনেক বড় একটি ভূমিকা রয়েছে এক্ষেত্রে । সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় বিষয়। আমরা অধিকাংশ মানুষ একবাক্যে তরুণদের বিচার করি। তাদের কোণঠাসা করে ফেলি এক কথায়- তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই কি তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? আমরা যদি একটু খেয়াল করি তবে দেখবো আমাদের তরুণেরাই অনেক ভালো ভালো কাজ করছে।তারা আগামীর ভবিষ্যৎ । তাদের জন্য মেধার বিকাশ ঘটাতে চলচ্চিত্র , নাটক তৈরি করা যেতে পারে। তাদেরকে ভালো ভালো কাজের সাথে এবং সৃষ্টিশীল কাজের সাথে নিযুক্ত করতে হবে। তাদেরকে নানান প্রতিযোগিতামূলক কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে। তারা যেন সকলের সাথে মিলে মিশে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
গ) সরকারের দায়িত্ব
সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের জন্য নানামুখী ব্যবস্থা নিতে হবে। খেলাধুলা, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি তৈরি করতে হবে পাড়া-মহল্লায়। তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে প্রতিটি এলাকায় পাঠাগার তৈরি করতে হবে। কারণ একমাত্র বই পারে সঠিক পথের দিশা দিতে। ই-বুকিং এর ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেহেতু শিশু কিশোরেরা ফোন, ল্যাপটপ , ট্যাবে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
একটি বাচ্চাকে মানসিক সুস্থতা নিয়ে বড় করতে বাচ্চার বাবা-মায়ের জন্য প্যারেন্টিং শিক্ষাটাও অনেক বড় ব্যাপার। প্যারেন্টিংয়ের কোনো কোর্স, ওয়ার্কশপ আমাদের নেই।
এছাড়াও পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে।বাচ্চার সব ধরনের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ছেলেমেয়েদের বিকশিত হওয়ার যথাযথ স্থান। এর জন্য যথাযথ পরিচর্যা প্রয়োজন।পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেমন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর নতুন আইন করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য। আমাদের দেশে ও নতুন আইন করে সোশ্যাল মিডিয়া যেগুলো আছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সময়ের দাবী।
উপসংহার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তি নানাভাবে সমাজের অবক্ষয় এবং ধ্বংস ডেকে আনছে ।ফলে পরিবার, সমাজ এবং সরকার সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবেই এই অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।সকলের স্বদিচ্ছা এবং পারিপার্শ্বিক সহযোগিতাই পারে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে।আমাদের তরুণ প্রজন্ম আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার গুরু দায়িত্ব আমাদের সকলের । ফলে, সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করতে হবে।