সাঈদুর রহমান রিমন :
সংবাদের পরিবর্তে সাংবাদিক নিজেই যখন বেশি প্রচারমুখী হয়ে উঠেন তখনই সংবাদের গুণগত মান বিনষ্ট হয়, আস্থা হারায় পাঠকের। পিটিসি দেয়ার সময় সাংবাদিকের চেহারা ও সাজগোছ প্রদর্শণ কিংবা মৌলিক ঘটনার পরিবর্তে সাংবাদিক নিজেই যখন হয়ে উঠেন মূখ্য বিষয়। রিপোর্ট লেখা হয়, ভোলার অমুক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের চাল চুরির তথ্য জানতে গিয়ে তিন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। তাদেরকে আহত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে অমুক, অমুক ইত্যাদি…।
এবার সাংবাদিক আহত হওয়ার বিষয়টিই হয়ে উঠে প্রধান সংবাদ, এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাংবাদিক সমাজ। ফলে চাল চুরির মূল খবরটি বেমালুম চাপা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে মৌলিক সংবাদের গুণগত মান রক্ষায় সাংবাদিক নিজে গৌণ হলেও সমস্যা কী?
দুর্নাম চর্চা, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, অপপ্রচার=অপসাংবাদিকতা। যা ফেসবুকের পাতায় পাতায় অহরহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নিজের আইডিতে স্ট্যাটাস দেয়ার নামে, গ্রুপে কিংবা পেইজে নিউজের আদলে এগুলো বেশি প্রকাশ করা হয়। আবার কেউ কেউ আগাম হুমকি দেয়ার স্টাইলেও অপসাংবাদিকতার বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা আরো সুন্দরভাবে হয়তো বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারবেন, তবে আমি মনে করি: যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও কর্মকান্ড ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকা উচিত যতক্ষণ তা দ্বারা অন্য কেউ ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হন। ধরুন এক দম্পত্তি প্রতি রাতে তাদের দরজা জানালা বন্ধ করে সারারাত মদ পান করেন, ড্যান্স দেন, গান বাজনায় মত্ত থাকেন। এমন কাজ যদি অন্য কারোর জন্য ডিস্টার্বের কারণ না হয় তাহলে সে বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। আইনগত ভাবে এ অধিকার নেই।
অথচ আপনি সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করলেন, ড্রোন বা স্পাইক্যাম ব্যবহার করে তার ঘরের দৃশ্যাবলী ভিডিও করলেন, সে কোথা থেকে মদ কিনে আনে তার রিসিট জোগাড় করলেন, সেসব প্রচারের উদ্যোগ নিলেন; এসবই আপনার অনৈতিকতা এবং অপরের প্রাইভেসী ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। মনে রাখা উচিত, কুটরামি, বদনামী চর্চা কখনোই সাংবাদিকতা নয়।
যে খবর সমাজ, রাষ্ট্র, জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো প্রভাব ফেলে না- তা কখনই সংবাদ হতে পারে না, সেসব নিয়ে সংবাদ প্রস্তুত বা প্রচার প্রকাশ করাটাও সাংবাদিকতা হতে পারে না।
আমাদের আরো কিছু সাংবাদিক বন্ধু এমন সব খবরের পেছনে ছোটেন, কষ্ট করেন, ঘাম ঝরান। যে খবরের সংবাদ মূল্য নেই, আপামর জনতা যে ঘটনার ব্যাপারে জানতে বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করে না, যে ঘটনা বা খবর সমাজে কোনো প্রভাব ফেলে না, যাতে সমাজ শুদ্ধ অশুদ্ধ হওয়ার কোনো বিষয় থাকে না- তা নিয়ে কতই না কষ্ট করেন সাংবাদিক বন্ধুরা।
নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেখুন, এমন খবর কেবলই কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা কর্মকর্তাকে খুশি করার জন্য হয়ে থাকে। এই একজনকে খুশি করার সংবাদটি পাঠিয়ে আপনি নিজে কতজন সাংবাদিক বন্ধুর কাছে নিজের অজান্তে প্রশ্নবিদ্ধ হলেন, পত্রিকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে আপনার গুরুত্ব কতটুকু কমতে থাকলো তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন?
সমাজে কখনো কখনো ন্যাক্কারজনক কিছু ঘটনা ঘটে যা সামাজিক অনুশাসনকে বিনষ্ট করে দেয়। সেসব সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকাটাই শ্রেয়। যেমন বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণের কাহিনী লেখা ও প্রচারের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে কি দিচ্ছি। অকল্পনীয়, জঘণ্য এ ঘটনা অন্যদের ভাবনায় আসার সুযোগ করে দেয়াটাও পাপ, অপরাধ। বলাৎকারের মতো ন্যাক্কারজনক খবর ছাপানোর ক্ষেত্রেও ‘পাশবিক নির্যাতন’ শব্দের মধ্যেই ঘটনাটি সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে রসবোধমূলক রগরগে কাহিনী সভ্য সমাজে প্রকাশ করা কোনো বাহাদুরী নয়। বরং এসব খবর এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে রুচিবোধের পরিচয়ও মেলে। অতএব সব ঘটনাই সংবাদ নয়, আর সংবাদ হলেও সব লেখা যায় না; লেখা উচিতও নয়।
যে কোনো নিউজ করার আগে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন : এ নিউজটি কেন করবো? কেন করবো না? এ নিউজ থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কি পাবে? নিজেকে নিজেই যদি গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে পারেন তাহলেই লিখুন। আরেকটি বিষয়, সংবাদ লেখা শুরুর আগেই নিজে কয়েক দন্ড ভাবুন; প্রশ্ন করুন নিজেকে….কি লিখতে চান? কি ম্যাসেজ দিতে চান সমাজ ও রাষ্ট্রকে। নিজের মোবাইলটির রেকর্ড অপশন অন করে আপনার সম্পাদককে মিছেমিছি সে কথা ফোনে বলুন। বলা শেষ হলে মোবাইল ফোনের রেকর্ডকৃত বক্তব্যটুকু শুনুন…এটাই হুবুহু লিখুন। আশা করি শ্রেষ্ঠ ইন্ট্রো হয়ে গেল।
যেসব তথ্য সত্য হলেও লেখা যাবে না, ছাপানো যাবে না
আমাদের বেশিরভাগ সংবাদকর্মি সার্বজনীন কোনো শপথনামা ছাড়াই সাংবাদিকতার পেশায় পা ফেলেন, ফলে নিজের দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ বিষয়ে বিস্তারিত না জানারই কথা। সাংবাদিকতার শুরুতেই জানার কথা, জাতিসত্তা বিনাশী এবং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সংবিধান বিরোধী বা পরিপন্থী কোন সংবাদ অথবা ভাষ্য প্রকাশ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও অর্জনের বিরুদ্ধে কোনভাবেই প্রচারণা করা যাবে না। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ায় কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ায় এমন সব রকম কর্মকান্ড, লেখনি থেকে অবশ্য অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
আরো যেসব কর্মকান্ড থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে, জনগণের ব্যক্তিগত অধিকার ও অনুভূতিতে আঘাত না করা, সকল প্রকার গুজব ও কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকা, রুচিহীন, অশালীন সংবাদ প্রকাশ না করা, বংশ, গোষ্ঠী, অঞ্চল ভিত্তিক দাঙ্গা হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ার মতো সকল প্রকার লেখনি থেকে বিরত থাকা অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। এগুলো সবই প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ১১ঃ (বি) ঃ ধারা অনুযায়ী প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকের জন্য অনুসরণীয় আচরণ বিধির অংশ।
সাঈদুর রহমান রিমন