শেখ হাসিনার পরিকল্পনা: মাত্র এক যুগে বদলে গেছে দেশের কাঠামো ও মানুষের জীবন
প্রকাশ: ১০ আগস্ট, ২০২২, ২:৫৭ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, আজকের বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে একটি বদলে যাওয়া দেশ। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল, কিন্তু দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের চাইতে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। স্বাস্থ্যসেবা খাতের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার মানুষের দোরগোরাতেও পৌঁছে গেছে স্বাস্থ্যসেবা। দেশের শতভাগ এলাকা এখন বিদ্যুতের আওতায়। স্কুলে পড়ার মতো বয়সী প্রায় শতভাগ শিশুই এখন স্কুলে যাচ্ছে। এমনকি এসএসসি পর্যায় পর্যন্ত একটা বড় সংখ্যার শিক্ষার্থীকে বৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে (প্রাইমারি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত) বিভিন্ন উপবৃত্তি এবং বৃত্তি দিচ্ছে সরকার।
দেশকে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ বিষয়ে নিজের লেখা এক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জানান- ১৯৭১ সালের শেষে যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলাম, তখন দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপি ছিল মাত্র ২,৫৫৪ ডলার এবং এর বৃদ্ধির গতিও একটা সময় পর্যন্ত ছিল খুবই ধীর। এমনকি মানুষের গড় আয়ু ছিল তখন মাত্র ৪৭ বছর। কিন্তু সেই অবস্থা বদলে গেছে। বাংলাদেশ এখন ১৬৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ এবং এর প্রবৃদ্ধিও খুব ভালো। এমনকি দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই বলতে চাই- এটি যেভাবে বেড়েছে, ঠিক সেভাবেই কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘স্ট্রাইভিং টু রিয়ালাইজ দ্যা আইডিয়ালস অব মাই ফাদার’ শিরোনামে লেখা সেই প্রবন্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো জানান, বাংলাদেশ এখন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হওয়ার পথে ধাবমান। ২০১০ সাল থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের ওপরে। এমনকি করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। মহামারির কারণে কিছুটা প্রভাব পড়লেও দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যঘাটতির দিন শেষ করে বাংলাদেশ এখন ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। ২০২০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।
গ্রামীণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে ৮ হাজার ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন পর্যায়ে। এরমধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করেছে। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে অল্ড সময়ের মধ্যেই উন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।
মাত্র এক যুগের মধ্যে এই অবিস্মরণীয় উত্তরণ কোনো অলৌকিক কিছু নয়। বরং সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, তৃণমূলের জন্য গৃহীত উদ্যোগ এবং নিজে থেকে কিছু করার জন্য মানুষের (উদ্যোক্তা হওয়া) অদম্য বাসনা, প্রভৃতির কারণে অনেক সংকট ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি আমরা।
জনগণের সাতটি মৌলিক চাহিদা পূরণের উদ্যোগ:
পিতা মুজিবের আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে প্রথমেই আমি গণমানুষের দিন বদলের জন্য সাতটি লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। তার গবেষণালব্ধ লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি, সেই লক্ষ্যগুলো হলো:
১. কৃষি ও খাদ্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং সর্বোস্তরের মানুষের জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা
২. সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা
৩. শতভাগ শিক্ষা
৪. অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প
৫. নারী এবং পিছিয়ে পড়ে জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে আসা
৬. শিশুদের জন্য কল্যাণকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত
৭. গণমানুষের আর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা
১. কৃষি, খাদ্য এবং পুষ্টি:
কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকার দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথযাত্রা শুরু করে। কারণ, এটি ঠিক থাকলে মানুষের জীবনযাত্রার অন্যান্য সুবিধাদিও বাড়ে। আর আমাদের দেশের সর্ববৃহৎ ক্ষেত্রটাই হলো কৃষি। কমপক্ষে ৪৩ শতাংশ মানুষ এই সেক্টরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই কৃষিজ উৎপাদন বাড়লে শুধু মানুষেরই আয় বাড়ে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটে।
কোনো দেশের মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা বাড়লে সেই দেশের কারখানা, শিল্প, বাজার, বাণিজ্য, এমনকি রফতানি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন ও গ্রামেও শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমনকি চাষের যোগ্য কোনো জমি যেনো অনাবাদি পড়ে না থাকে সেজন্য চারটি বিশেষ উদ্যোও নেয় সরকার।
(ক). সার ও বীজ সরবরাহ: কৃষকদের উন্নত জাতের ও উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার এবং সেঁচ সুবিধা অন্যান্য কৃষিজ সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়।
(খ) অর্থায়ন: চাষিদের জন্য বিনা জামানতে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ চালু করা হয়। উন্নত চাষাবাদে সহায়তার জন্য কৃষকদের জন্য ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং নগদ অনুদান দিতে শুরু করে সরকার। (গ) গবেষণা: শস্য, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বহুমুখী গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা। এই গবেষণার কারণেই ইতোমধ্যে নতুন জাতের ভুট্টা, গম, সবজি এবং ফলমূল চাষ করা শুরু হয়েছে। উপকূল অঞ্চলের জন্য লবণাক্ত-পানি সহনীয় ধানের জাত, জলাশয়ে দেশীয় মাছের চাষ এবং একই জমিতে একই সঙ্গে ধানের চাষ করার স্কিম শুরু করেছে সরকার, যাতে বর্ষাকালে একই জমিতে একই সঙ্গে মাছ এবং ধানের চাষ হতে পারে। পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের সচেতন করার কাজও করে যাচ্ছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা।
(ঘ) চাষিদের আধুনিক শিক্ষাদান: আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে কৃষকদের মধ্যে নিয়মিত জ্ঞান বিতরণ ও তাদের কৃষি ও চাষাবাদ বিষয়ে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে মাটি পরীক্ষা করে তারা বুঝতে পারবে যে, কোন জমিতে কোন সার কী পরিমাণে প্রয়োজন। এছাড়াও পণ্যের বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষণেও বিষয়েও শিক্ষিত করা হচ্ছে কৃষকদের। ফলে বাংলাদেশের প্রায় সম-আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সমান পরিমাণ কৃষিজ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষে বার্ষিক উৎপাদনের হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে দ্বিতীয়, এবং সবজি উৎপাদনেও এখন বিশ্বে তিন নম্বর অবস্থানে বাংলাদেশ।
২. স্বাস্থ্য:
গণমানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেশজুড়ে বড় পরিসরে কাজ করছে সরকার। যেমন- হাসপাতাল এবং ক্লিনিক নির্মাণ, সর্বোস্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, রোগ প্রতিরোধ এবং সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা। আমাদের দেশ হয়তো এখনো স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো উন্নত অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু বিগত বছরগুলোতে আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি এসব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার এই সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত করবে।
(ক) কমিউনিটি ক্লিনিক: দেশজুড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সরকার গণমানুষকে ফ্রি-চিকিৎসাসেবা এবং ওষুধ সরবরাহ করছে। শিশু এবং মায়েদের জন্য দেওয়া হচ্ছে বিশেষ সেবা। এসব চিকিৎসালয়ে সেবাগ্রহীতার নাম রেজিস্টার্ড করা হয়, যাতে তারা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।
(খ) ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সবচেয়ে ছোট ইউনিট হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আরো মেডিক্যাল সুবিধার জন্য করা হয়েছে মাতৃ ও শিশুসেবা কেন্দ্র। আরো একটু বড় পরিসরে উন্নত করা হয়েছে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতালগুলো।
(গ) মাতৃত্বকালীন সেবা: অন্তঃসত্ত্বা এবং শিশুর জন্মদানের পর নারীরা এখন অনেক রকমের সেবা পাচ্ছে। কর্মজীবী নারীদের দেওয়া হচ্ছে মাতৃত্বকালীন ভাতা, যাতে তারা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করেন এবং স্বাস্থ্যবান সন্তান জন্ম দিতে পারেন। যে মায়েরা শিশুদের দুধ পান করান, তাদের জন্য মাসে ১০ ডলার করে ভাতা চালু করেছি আমরা।
(ঘ) স্বাস্থ্যবিধি: শিশুদের নিয়মিত টিকাদান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে নিয়মিত মোটিভেশন দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক বাথরুমের ব্যবস্থাও কো হয়েছে।
(ঙ) সচেতনতা বৃদ্ধি: স্বাস্থ্য সচেতনতার ব্যাপারে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে নার্স, ধাত্রী এবং নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়; যাতে তারা নারীদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারেন। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও নবোজাত শিশুদের সুস্বাস্থ্যের জন্য অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং করানো হয় এসব হেলথ সেন্টার থেকে। যার ফলে মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে এবং মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
(চ) নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সংবেদনশীলতা: নারীরা বিশেষ করে মেয়েরা তাদের যে কোনো সমস্যার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নিতে পারে। এজন্য কারো উপর নির্ভর করতে হয় না তাদের। নিজেরাই ক্লিনিকে গিয়ে বয়ঃসন্ধিকালীন যে কোনো সমস্যার ব্যাপারে সেবা নিতে পারে। এছাড়াও সমাজের সিনিয়র সিটিজেন তথা বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকরাও এসব ক্লিনিকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন।
(ছ) হাসপাতালের পরিধি বৃদ্ধি: সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেশের প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় একটি করে হাসপাতাল থাকবে। আর এসব হাসপাতালের বেড সংখ্যা এলাকার জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি করা হবে। বর্তমানে ১৫২টি উপজেলা হাসপাতালের বেড সংখ্যা ৩১ থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩৪টি জেলা হাসপাতালের বেড সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০-৩০০টি করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে বাকি সব জেলা এবং উপজেলা হাসপাতালের বেড সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
(জ) সরঞ্জামাদির আধুনিকীকরণ: হাসপাতালগুলোতে আধুনিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ এবং সেগুলো ব্যবহারের জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে ওয়েব-ক্যামেরা সংযোগ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীকে সামনাসামনি দেখতে যেতে ব্যর্থ হলে ভিডিওতে দেখে চিকিৎসা দিতে পারে। একইভাবে অনলাইনের মাধ্যমে ববিদেশের চিকিৎসকদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার সুবিধাও চালু করেছে সরকার।
(ঝ) সেবিকাদের উন্নত প্রশিক্ষণ: নার্স বা সেবিকাদের মহান পেশার মর্যাদা বৃদ্ধি ও তাদের স্বীকৃতির জন্য আমরা নার্সিং কলেজ এবং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে এখন নার্সদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এখন কোর্স করে ডিগ্রি নিয়ে তারপর এই পেশায় আসতে হচ্ছে নার্সদের। দেশে নার্সের সংখ্যা, তাদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য সবিধাদিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। নার্সদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রাইভেট সেক্টরকেও উৎসাহ দিচ্ছে সরকার।
(ট) প্রাইভেট হাসপাতাল: চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধির জন্য সরকার দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। যার ফলে, ইতোমধ্যে দেশে কয়েকটি বিশ্বমানের প্রাইভেট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসক ও সেবিকাদের জন্যেও দেশে ও বিদেশে উন্নত-শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে সরকার।
(ঠ) বিশেষায়িত হাসপাতাল: সবরকমের রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন: সরকার চক্ষু, নাক, কান, গলা, ক্যান্সার, কিডনি, হার্ট, গ্যাস্ট্রো-লিভার, বার্ন ইউনিট, নিউরোসায়েন্স, ট্রমা প্রভৃতি পৃথক পৃথক চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতাল নির্মাণ করেছে সরকার। এমনকি নারী ও শিশুদের জন্যেও তৈরি করা হয়েছে বিশেষায়িত পৃথক হাসপাতাল।
(ড) করোনার অতিমারি মোকাবিলা: করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে কোভিড ইউনিট খোলা হয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের তুলনায় অতিমারি মোকাবিলায় ভালো করেছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অত্যাধুনিক ওষুধের সরবরাহ না থাকার পরেও- সরকারের সচেতনতা কর্মসূচি এবং রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি ওইসব রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক কম।
৩. শিক্ষা
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পরপরই শখে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সর্বজনীন শিক্ষার জন্য বহুমুখী উদ্যোগ নেয়। কারণ জনসংখ্যাই আমাদের মূল সম্পদ। তাই এই জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। শিক্ষিত জনগণেন সৃজনশীল উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়ে এবং তারা নিজেদের সমস্যার সমাধানে সক্ষম হন। শিক্ষিতরা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন, ফলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সরকার বয়স্ক শিক্ষা চালু করে। ফলে আমাদের দেশের সর্বোস্তরের মানুষ ধীরে ধীরে শিক্ষার আওতায় চলে আসে।
(ক) শিক্ষার হার: সরকার প্রতিটি জেলার মানুষকে শিক্ষিত করতে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, ফলে পাঁচ বছরে শিক্ষার হার ৪৫ শতাংশ থেকে ৭৫.৬ শতাংশে উন্নীত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন সরকারে ছিল না, তখন শিক্ষার এই হার আবারো কমে যায়। কিন্তু ২০০৯ সালে আবারো আওয়ামী সরকার গঠনের পর শিক্ষার হার বাড়তে শুরু করে। টানা তিন মেয়াদ ধরে কাজ করার কারণে মানুষের সাক্ষরতার হার আবারো প্রায় ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
(খ) আর্থিক সহায়তা: প্রাইমারির ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে নিয়মিত বৃত্তি দিচ্ছে সরকার, ফলে অভিভাবকদের ওপর থেকে সন্তানদের শিক্ষার জন্য খরচের চাপ কিছুটা হলেও কমছে। এই বৃত্তির টাকা সরাসরি শিক্ষার্থীর মা অথবা বৈধ অভিভাবকের মোবাইল ফোনে চলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যায়েও আমরা বৃত্তি দিচ্ছি। ফলে প্রাইমারি থেকে পরবর্তী ধাপে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের হার বাড়ছে।
(গ) শিক্ষা উপকরণ: এসএসসি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে বই সরবরাহ করছে সরকার। এছাড়াও স্কুলগুলোতে টিফিনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ফলে মাঝপথে ঝরে পড়ার হার অনেক কমে এসেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও অনলাইন, রেডিও এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রেখেছে সরকার।
(ঘ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা: বিজ্ঞান এবং তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক দক্ষতা বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন শেখ হাসনিা। টেকনিক্যাল শিক্ষারও বিস্তার ঘটানো হয় সেসময়। বর্তমানে দেশের ৪৯২টি উপজেলায় টেকনিক্যাল শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান চালু আছে।
(ঙ) সব বিভাগে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার দেশের আটটি বিভাগেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। বিশেষ করে সব জেলায় মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেকনিক্যাল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য ২০০৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
(চ) নারী শিক্ষা: শুধু নারীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে চারটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে সরকার। সাধারণ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, এমনকি শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে- নারী শিক্ষার্থীর হার বেশি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার সফল বাস্তবায়নের কারণেই এসএসসি পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৫৫.০৭ শতাংশ, এইচএসসি পর্যায়ে বেড়েছে ৫০.২৭ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আগের তুলনায় নারী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩৫.২১ শতাংশ।
একইসঙ্গে এসএসসি পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমেছে ৬৪.৯২ শতাংশ থেকে ৩৪.৮৬ শতাংশ, এইচএসসি পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমেছে ৪২.৪৮ শতাংশ থেকে ২২.০২ শতাংশ। নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির কারণে সমাজেও অনেকরকম ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যেমন- বাল্যবিয়ের হার কমেছে। মেয়েদের এখন আর পরিবারের বোঝা মনে করেন না অভিভাবকরা।
(ছ) মহামারিকাল: মহামারিকালে সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। তবে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা বিশেষভাবে লেখাপড়া চালু রাখতে সক্ষম হয় মরকার। ডিজিটাল প্লাটফর্ম এবং টেলিভিশন ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালু রাখা হয়।
৪. আশ্রয়ণ:
বাংলাদেশে যতো ধরনের অসমতা রয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম একটি হলো বাসস্থান। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে শেখ হাসিনার সরকার গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্রের হারও কমতে থাকে, ফলে সমাজের অসাম্য হ্রাস পেয়ে সমতা বৃদ্ধি পায়। এই উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ভূমিহীনদের মাথাগোঁজার ঠাঁই দিতে তিনি গুচ্ছগ্রাম তৈরি করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও রাষ্ট্রীয় ভূমি ব্যবহার করে অসহায় মানুষদের ঘর করে দেওয়ার সেই উদ্যোগকে আরো সম্প্রসারিত করেছে।
(ক) সব গৃহহীনের জন্য ঘর: ভূমিহীনরা যাতে একটি বাড়ি পায় তা নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনার সরকার প্রথমে আশ্রয়ণ-১ প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে একেকটি গৃহে একটি থাকার ঘর, একটি বারান্দা ও দুই দিকে খালি জায়গা রাখা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলে, তখন এই বাড়ির মালিকারা পাবেন স্ত্রী। তবে এই বাড়ি কেউ কারো কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবে না। একেকটি স্থানে বেশকিছু ঘর তৈরির মাধ্যমে এসব ব্যক্তিদের সমবায়ভিত্তিক জীবনের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে। আশ্রয়ণ-১ এর বাড়িগুলোতে বসবাসকারী ব্যক্তিদের কামার, কুমার, জেলে ও নরসুন্দরের মতো পেশায় গিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে সরকার আরো সুন্দর ডিজাইনের মাধ্যমে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। যে পরিমাণ ঘর নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার অর্ধেক কিন্তু নির্মাণ করাও হয়েছে। বাকি ঘরগুলোর নির্মাণ কাজ এবং হস্তান্তর আগামী দুই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে।
(খ) গৃহায়ণের জন্য তহবিল: যাদের ভূমি আছে কিন্তু গৃহ নাই, তাদের গৃহ নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি তহবিল করা হয়েছে। যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে এই অর্থ নিতে পারে, সর্বোচ্চ সুদহার এখানে মাত্র ৫ শতাংশ। ২৯ হাজার পরিবার এখন পর্যন্ত এই খাত থেকে অর্থ নিয়ে ঘর নির্মাণ করেছে। এছাড়াও পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আলাদা হোস্টেল।
(গ) বস্তিবাসীর জন্য গৃহ: শহরের বস্তিতে বসবাসকারীদের জন্য সরকার ছোট ছোট ফ্লাট নির্মাণের কাজ করছে। এসব ফ্লাটে থাকতে হলে প্রতিদিনের ভিত্তিতে, প্রতি সপ্তাহ এবং মাসিক হিসেবে ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এমনকি শহরের বস্তিতে বসবাসকারী ব্যক্তিরা যারা গ্রামে ফিরতে আগ্রহী, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চালু করা হয়েছে বিশেষ ঋণ, স্বল্প সুদের এই ঋণ নিয়ে যেনো নিজেদের কোনো পেশায় নিয়োজিত করতে পারে গ্রামে ফেরা মানুষেরা। গ্রামে ফিরলে তাদের জন্য করা হচ্ছে গৃহের ব্যবস্থা এবং ছয় মাসের খাওয়ার খরচও দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
৫. নারী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী:
বৃদ্ধ, বিধবা, প্রতিবন্ধি, অতি দরিদ্র, আসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সামাজিক সরক্ষা বলয়ের আওতায় অর্থ সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার।
চলতি অর্থ-বছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতয্সেরকারইতোমধ্যে ৯৫৬ মিলয়ন টাকা (প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ করেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, বেদে, ভাসমান মানুষসহ সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর কমপক্ষে সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই সামাজিক নিরাপত্তা সেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
(ক) বিশেষ প্রশিক্ষণ: নারীদের স্বনির্ভর করতে সরকার বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ এবং তাদের জন্য বিশেষভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা চালু করেছিলেন, সরকারি কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা চালু করেন, সেই পথ ধরেই আজ প্রাইমারি শিক্ষকতায় ৬০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে, কারণ প্রাইমারি স্কুলগুলোতে নিজ অঞ্চলে থেকেই চাকরি করতে পারেন নারীরা, আর বিশেষায়িত কোনো দক্ষতাও এজন্য প্রয়োজন হয় না। ফলে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, নারীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আরো আকৃষ্ট হচ্ছেন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে।
(খ) নারী নীতি এবং নারীদের চাকরিতে নিয়োগ: নারীদের উন্নয়নের জন্য ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি করা হয়। তবে পরবর্তীতে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তার কোনো বাস্তবায়নই হয়নি। পরে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর, আওয়ামী লীগ সরকার সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে বিচারক হিসেবে, প্রশাসনের সচিব, জেলা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহনী কর্মকর্তা, বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ হিসেবে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়াও সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীতে নারীর পদায়ন, সীমান্তে বিজিবি এবং বিভীন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য পদে নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
(গ) স্থানীয় সরকার: স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বিভিন্ন পদেও নারীর অংশগ্রহণ করেছে নিশ্চিত করেছে সরকার। ইউনিয়ন থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে নারীকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করাটা এখন বাধ্যতামূলক। যার ফলে, দেশের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। ফলে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
৬. শিশুদের জন্য কল্যাণকর পদক্ষেপ:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা তার প্রবন্ধে লিখেছেন- ১৯৭০ এর দশকে আমার বাবা শিশুদের কল্যাণের জন্য অনেকরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার সংক্ষিপ্ত সময়ের শাসনামলেই তিনি শিশু আইন পাশ করেন এবং সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে প্রাইমারি শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেন। বাবার এসব উদ্যোগ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।
(ক) শেখ হাসিনার সময়ে জারি করা আইন ও নীতিমালা: নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণ প্রতিহত করতে অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশুদের প্রতি অপমানজনক আচরণকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। প্রণয়ন করা হয়েছে- পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭।
(খ) নীতি এবং পরিকল্পনা: শিশুদের কল্যাণের জন্য বেশকিছু নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জাতীয় শিশু নীতি ২০১১; যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিশু বিষয়ক নীতিমালা, সংবিধান এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক পরিকল্পনা ২০১৩-২০১৫-কে সমন্বয় করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯৯৬ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শিশুশ্রম। সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে মাঠে সক্রিয় থেকে নারী ও শিশুর কল্যাণে যেসব কাজকর্ম করেছে, শুধু কাগজে প্রণীত কয়েকটি আইন বা নীতিমালা দেখে এর ব্যাপ্তি বোঝা যাবে না। এসব বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
(গ) শিশুদের জন্য সুবিধা: ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে থাকা দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার পরিসর ও সুবিধা বাড়াতে বিভিন্ন রকম কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সরকারি প্রতিটি সেক্টরেই আমরা শিশুদের জন্য ‘চাইল্ড কেয়ার’ এবং ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’ স্থাপন করেছি। চাকরিজীবী নারী, বিশেষ করে গার্মন্টসে কাজ করা কর্মজীবী নারীদের খুব উপকার হয়েছে একারণে।
(ঘ) সহিংসতার বিরুদ্ধে কর্মসূচি: ছেলে-মেয়েদের বয়োঃসন্ধিকালীন সহিংসতা প্রতিরোধে দেশের সব উপজেলার সঙ্গে মোট প্রায় ৫ হাজার ২৯২টি ক্লাব ভার্চুয়ালি যুক্ত আছে। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফর অটিজম এবং নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় হেল্প লাইন এবং সারা দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ৬০টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করা হয়েছে।
(ঙ) খেলাধুলা: খুলাধুলার সঙ্গে শিশুদের সম্পৃক্ত রাখতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়। ২০১৯ সালে ৬ হাজার ১৪২টি দলের (টিমের)মাধ্যমে ১ লাখ ১০ হাজার ৩৫৪ জন শিশু ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আয়োজিত এসব টুর্নামেন্টে পৃথকভাবে অংশ নিয়ে ছেলে-মেয়ে উভয়েই।
(চ) সরাসরি আর্থিক সাহায্য: আমার সরকার শিক্ষার্থীদের প্রতি সবসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখে। তরুণ শিক্ষার্থী, তাদের মা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং অনেক বেসরকারি সংস্থা যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করে; তাদের সবার খোঁজখবর রাখে সরকার। আমি উল্লেখ করতে চাই যে, ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে তাদের মায়ের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এছাড়াও এসএসসি, এইসএসসি ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের মধ্যে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ৭৩ লাখ শিক্ষার্থীকে। এছাড়াও শিশুদের কল্যাণের জন্য বিনামূল্যে বই, স্কুলের পোশাক, টিফিন সরবরাহ করা হচ্ছে।
৭. অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি:
আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিতে এখন অধিকতর অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, প্রথমে বৃটিশ ও পরে পাকিস্তানিতদের আমলে আমাদের সমাজে যেসব বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, মানুষ এখন সেসবের বিরুদ্ধে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সমাজের সর্বোস্তরের মানুষকে একসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্যোগ নেন, সেই ধারাবাহিকতাতেই আজ সাম্যভিত্তিক নীতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের সঙ্গে সমাজকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জনগণের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিচের কয়েকটি উদাহরণ দেখলেই যে কারো কাছে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
(ক) মোবাইলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সেবা: যখন ডিজিটাল যোগাযোগ ডিভাইসগুলোকে সহজলভ্য করা হলো এবং সেগুলো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো, তখন জননেত্রী ভাবলেন যে- এগুলোকে সহজেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাজে লাগানো যায় এবং এটি করতে পারলে গণমানুষের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়বে। একারণে ২০০৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠনের পর, আওয়ামী লীগ সরকার মোবাইলের মাধ্যমে টাকা লেন-দেন চালু করে। এখন আমাদের দেশে ৮ কোটিরও বেশি মানুষ মোবাইলের মাধ্যমেই অর্থ লেন-দেন করছে।
(খ) ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা: শুধু স্বল্প বিনিয়োগের উদ্যোক্তাদের পাশে থাকার জন্যই এই সরকারের আমলেই কর্মসংস্থান ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ব্যাংক থেকে তরুণ উদ্যোক্তা এবং নারীরা বিনা জামানতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। বিভিন্ন স্টার্ট-আপের প্রশিক্ষণ নিয়ে, স্বল্প সুদের এই ঋণ গ্রহণ করে যে কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে এখন।
(গ) ক্ষুদ্র-সঞ্চয়: আমি স্বল্প আয়ের মানুষদের সঞ্চয়ের জন্য একটি চিন্তা করেছিলেন শেখ হাসিনা, যা পরবর্তীতে ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। নেত্রীর উদ্দেশ্য ছিল যে, গ্রামের মানুষদের সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলা, তাদের মধ্যে সমবায় ভিত্তিতে উৎপাদনমুখী কাজের পরিধি বৃদ্ধি করা। এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেশ থেকে দারিদ্র দূর করা। এটাই ছিল আমার চিন্তা। যাদের বাড়ি আছে, তারা যেনো বাড়ি আশেপাশের পুকুর বা জমিতে মাছ বা সবজি চাষ করে। কোনো জায়গা যেনো খালি না রাখে। আর যারা আরেকটু মেধাবী আগ্রহী তাদের জন্য হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প, ফল চাষ, মাশরুম চাষ এবং আরো যেসব চাষাবাদ করা সম্ভব, তারা যেনো তা করে। আবার মাছ চাষ, পোল্ট্রি চাষ, কবুতর বা কোয়েল চাষের মাধ্যমেও মানুষ আয় বাড়াতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের দর্শনটা হলো- মূল্যবান একটু জায়গাও যেনো পড়ে না থাকে। গ্রামের মানুষ যেনো উৎপাদনমুখী হয়, সেজন্য সরকার যাবতীয় প্রণোদনা ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।
(ঘ) বিশেষ প্রণোদনা: উৎপাদন এবং সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য এই সরকার প্রথমে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে তারা ঋণ নিয়ে সফলভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। এরপর যদি কোনো ব্যক্তি তার লাভ থেকে কিছু সঞ্চয় করে, তাহলে সরকার সম-পরিমাণ অর্থই উপহার হিসেবে তাকে দিচ্ছে, ফলে তার অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার মানুষকে সঞ্চয় বৃদ্ধির এই সুবিধা দিচ্ছে।