তখন ঘরে ঘরে ছিল না মুঠোফোন কিংবা টেলিভিশন। দেখা যেত, গ্রামের কোনো এক বাড়িতে কারও হাতে নকিয়া ব্র্যান্ডের মুঠোফোন আছে। আবার পুরো গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির বাড়িতে একটিমাত্র টেলিভিশন আছে, যা দেখার জন্য গ্রামের লোকজন প্রতিদিন সকাল, সন্ধ্যা কিংবা দুপুরেও ভিড় জমাত। তবে এগুলো না থাকলেও তখনকার সময়ে ছিল রেডিও। প্রায় সবার বাড়িতেই ছোট কিংবা বড় সাইজের নানা ধরনের রেডিও দেখা যেত। বিনোদন কিংবা শিক্ষার সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল রেডিও। আমাদের শৈশবের বেশির ভাগ অংশজুড়েই আছে রেডিও নামক অসাধারণ এক যন্ত্রের ভাস্বর স্মৃতি।
প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকত সকাল সাতটার সংবাদ। কারণ, গত দিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সকাল সাতটার সংবাদে পাঠ করে শোনানো হতো। ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলাম বিধায় ক্রিকেটের খবর শোনা একরকম বিস্ময়ের মতো লাগত সব সময়। সংবাদ পাঠ করার সর্বশেষ পর্যায়ে খেলার সংবাদ পাঠ করা হতো, যা শুনে খুব আনন্দ পেতাম। বিশেষ করে যেদিন রাতের বেলায় বাংলাদেশের খেলা থাকত, সেদিন খেলার ফলাফল কী হয়েছে, সেটি জানার জন্য অধীর আগ্রহে রেডিও নিয়ে খবরের শেষ অংশের জন্য অপেক্ষা করতাম। এটি যে কত মধুর, সেটি বলে বোঝানো কখনোই সম্ভব নয়। আর যদি বাংলাদেশ জিতে যেত কোনো খেলায়, তাহলে প্রচণ্ড খুশি লাগত, আনন্দ হতো প্রচুর। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ঈদের খুশির আমেজ বয়ে যেত।
ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য শোনা নিয়ে রেডিওর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা ধরনের স্মৃতি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চুরি করে রেডিও দিয়ে খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম। চুরি করে খেলার ধারাভাষ্য শোনার জন্য মা-বাবার কাছে কত যে বকা খেয়েছি, তার ঠিক নেই। তবে বকা খেলেও কখনো খেলার ধারাভাষ্য মিস করতাম না। চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফতের দরাজ কণ্ঠ আজও মনে করিয়ে দেয় সেই মধুর স্মৃতিগুলো।
তা ছাড়া সকাল আটটায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘দর্পণ’ নিয়মিত শুনতাম। এখান থেকে নানা ধরনের সাধারণ জ্ঞানের তথ্য জেনে নিতাম। এরপর সকাল নয়টায় বাংলাদেশ বেতার খুলনা থেকে প্রচারিত হতো গানের অনুষ্ঠান, সেটা শুনতাম নিয়মিত। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতার ঢাকায় প্রচারিত হতো অনুরোধের গানের আসর, যেখানে শ্রোতারা অনুরোধ করত বিভিন্ন গান শোনার জন্য। এগুলো শোনানো হতো চিঠি পড়ার মাধ্যমে। অসাধারণ সেই দিনগুলোর কথা স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে এখনো।
এরপর বেলা দুইটার দিকে শুরু হতো বিভিন্ন ধরনের গানের অনুষ্ঠান, যেগুলো শুনতাম নিয়মিত। বিকেলে খুব কমই শোনা হতো রেডিও। তবে সন্ধ্যা লাগলেই বসে যেতাম রেডিও নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার সংবাদ ও আটটার সংবাদ শোনার জন্য। রাত সাড়ে আটটায় প্রচারিত হতো খেলাধুলার সংবাদ, যা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম প্রতিনিয়ত। সন্ধ্যার সময় নির্দিষ্ট বারে প্রচারিত হতো সৈনিকদের নিয়ে অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’। অনুষ্ঠানটি আমার খুবই পছন্দের ছিল। এ ছাড়া ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই পল্লিগীতি কিংবা ভাওয়াইয়া শোনানো হতো, যেটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। এখনো আমি সেসব গান ভুলতে পারিনি।
তখনকার সময় রেডিও ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শৈশবের রঙিন ও মধুর সময় কেটেছে রেডিওর সঙ্গে। রেডিও শোনার মাধ্যমে যেমন নতুন নতুন জিনিস শিখেছি প্রতিনিয়ত, তেমনি আমাদের বিনোদনের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ছিল রেডিও।
অসাধারণ সব সময় পেরিয়ে গেছে, সময়ের আবর্তনে মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে। রেডিও আর এখন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়; মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে মুঠোফোন। রেডিও হারিয়ে ফেলেছে তার সেই পুরোনো ঐতিহ্য। হারিয়ে যেতে বসেছে কালের অতল গহ্বরে। এখন আর শ্বশুরবাড়ি থেকে উপহার হিসেবে কোনো জামাইকে রেডিও দেওয়া হয় না! তাই তো রেডিও এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রেডিও আর টিকতে পারেনি। তবে এ সমাজব্যবস্থায় রেডিও টিকতে না পারলেও রেডিও টিকে আছে আমাদের শৈশবের রঙিন দিনগুলোজুড়ে; রেডিও টিকে আছে আমাদের মনের মণিকোঠায়!
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।