শাকিরুল আলম শাকিল :
ছোটবেলায় বাড়িতে যখন ঢাকা থেকে কোনো মেহমান আসতেন তাদের পৌঁছে দিতে লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে হতো। সেখানে বড় বড় লঞ্চ দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। কী বিশাল আকৃতির দেহ নিয়ে একেকটি লঞ্চ প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছে মাইলের পর মাইল জলপথ। আবার তাকে ভাসিয়ে রাখতে মাস্টার রুম, ইঞ্জিন রুমে চলে কত আয়োজন। এসব দেখতে খুব ভালো লাগত। তখন থেকেই লঞ্চের প্রতি একটা অন্যরকম আকর্ষণ তৈরি হয়। ইত্তেফাক প্রজন্মের সাথে আলাপচারিতায় এভাবেই বলতে শুরু করেন এন.এফ.এস প্রোডাকশন লিমিটেডের পরিচালক নাদিম মাহমুদ শুভ।
শুভর জন্মস্থান নদীবেষ্টিত ঝালকাঠি জেলায়। তাই ভৌগোলিক কারণে জল ও জলযানের সাথে সখ্যতা। তবে লঞ্চের প্রতি টানটা একটু বেশিই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার শুভর মনে হলো— বড় লঞ্চের আদলে একটি রেপ্লিকা তৈরি করা গেলে তো দারুণ হয়। একটি খেলনা গাড়ির মটর ও কিছু সরঞ্জাম জোগাড় করে কাজে নেমে পড়েন। নির্মাণ কৌশলটা রপ্ত করেন ইউটিউব দেখেই। অল্প কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় সুন্দরবন-১২ লঞ্চের আদলে ৩ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি রেপ্লিকা তৈরি করেন। কিন্তু প্রথম ট্রায়ালেই ডুবে যায় লঞ্চটি। পরে জানতে পারেন, এতে বায়ু নিরোধক সামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। কিছুটা মন খারাপ হলেও এখানেই থেমে যাননি শুভ। কিছুদিন পর লঞ্চ-রেপ্লিকা তৈরিতে দক্ষ এক প্রবাসীর সাথে পরিচয় হয় তার। সেই গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে আবার মনোনিবেশ করেন নতুন লঞ্চ তৈরিতে। এবার কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের অনুকৃতি তৈরি করেন। ট্রায়াল পর্বে উত্তীর্ণ হলে ১৫ হাজার টাকায় সেটি কিনে নেন একজন।
এরপর থেকে বাণিজ্যিকভাবে লঞ্চ-রেপ্লিকা তৈরি করা শুরু করেন শুভ। এ পর্যন্ত প্রায় ২৭টি লঞ্চ রেপ্লিকা বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করেছেন। যার মধ্যে গ্রিন লাইন, মানামী, প্রিন্স আওলাদ, পারাবত, কীর্তনখোলা, শতাব্দি বাঁধন উল্লেখযোগ্য। গড়েছেন এন.এফ.এস প্রোডাকশন লিমিটেড নামে রেপ্লিকা তৈরির প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকের অগ্রিম অর্ডার নিয়ে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে দেন রেপ্লিকা। অনুকৃতি তৈরিতে কোনো অংশে ফাঁক রাখেন না শুভ। মূল লঞ্চের একদম হুবহু না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যান কাজ। এজন্য একেকটি লঞ্চ তৈরিতে সময় নেন প্রায় দেড় থেকে দুই মাস।
কেবল লঞ্চ নয়, শুভ স্পিডবোড, বাস, বিমানের রেপ্লিকাও তৈরি করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখাপড়া করছেন শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেরিন প্রকৌশল বিভাগে।
শুভ বলেন, ‘আমাদের দেশে রেপ্লিকা তেমন প্রসিদ্ধ না হলেও বাইরের দেশে চাহিদা অনেক। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ব্রাজিল, ডেনমার্ক, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ায় রেপ্লিকা নির্মাণ হচ্ছে। সেখানে কর্মজীবন থেকে অবসরের পরে অনেকেই মাতছেন এ শখে। নিছক খেলার ছলে নয়, দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজন থেকেই তৈরি করছেন এগুলো। মাছ ধরাসহ নানা কাজে ব্যবহারও করছেন’।
শুভর ইচ্ছে, তার প্রোডাকশন হাউজকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি রকেট স্টিমারের মতো যেসব জলযান বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের অনুকৃতি তৈরির মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।