রাস্তায় বের হলেই দেখা মিলে ভিখারিদের। মাঝেমাঝে তাদের দুর্দশা দেখে টাকা দিয়ে সহায়তা করে থাকেন অনেকে। কিন্তু এতে কি তাদের জীবন বদলায়? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর না, বদলায় না। তাই অনুদান নয় বরং ভিক্ষুকদের ওপর বিনিয়োগ করলে বদলে যাবে তাদের জীবন। আর অনন্য কাজটি করে দেখিয়েছেন ভারতের ওডিশা রাজ্যের সমাজকর্মী চন্দ্র মিশ্র।
‘দান নয়, বিনিয়োগ’ এ স্লোগানে ভিখারিদের নিয়ে তিনি গড়েছেন প্রতিষ্ঠান। যার নাম রেখেছেন ‘বেগারস কর্পোরেশন বা ভিখারিদের কর্পোরেশন।’ এর মধ্য দিয়ে তিনি ১৪ জন ভিখারির জীবন পাল্টে দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, চন্দ্র মিশ্র জানান, ছয় মাসের মধ্যে বিনিয়োগের ওপর সাড়ে ১৬ শতাংশ রিটার্নসহ অর্থ ফেরত দিয়েছিলেন বিনিয়োগকারীদের। তাই তিনি অনুদান নয় বরং বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে চন্দ্র মিশ্র বলেন, এক সময় তিনি গুজরাটে থাকতেন। সেখানেই এ বিষয়ে প্রথমবার মতো ধারণা পান তিনি। মূলত সেখানে একটি মন্দিরের বাইরে বসে মানুষকে ভিক্ষা করতে দেখছিলেন। তখনই তিনি ঠিক করেন, এসব ভিখারিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন।
এই কর্মসংস্থান নীতি নিয়ে কাজ করে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বারানসি পৌঁছান মিশ্র। সেখানে তিনি জনমিত্র ন্যাস নামের একটি স্থানীয় এনজিওর সঙ্গে তার ওই আইডিয়া নিয়ে কথা বলেন। তারাও ভিক্ষুকদের নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়।
বারানসির ঘাটগুলোর সমীক্ষার পর মিশ্র জানতে পারলেন সেখানে ভিক্ষুকের অভাব নেই। তখন তিনি উদ্যোগ নেন সেখানে ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলবেন, তাদের কাজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একজন ভিক্ষুককেও তিনি নিজের সঙ্গে কাজ করতে রাজি করাতে পারেননি।
কিন্তু ২০২১ সালে এসেই সে দৃশ্য বদলে যায়। দেশে তখন দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন চলছে। তখন রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, পর্যটক নেই, স্বাভাবিকভাবে ভিক্ষুকদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক তখনই অনেক ভিক্ষুক মিশ্রর কাছে আসেন কাজের জন্য। আর সে বছরের আগস্ট মাসেই প্রতিষ্ঠা করা হয় বেগারস কর্পোরেশন।
মিশ্র জানান, একজন নারী যিনি সন্তানকে নিয়ে বারানসির ঘাটে ভিক্ষা করতেন তিনি প্রথম কাজের জন্য তার কাছে এসেছিলেন। স্বামী বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করেই দিনাতিপাত করতেন ওই নারী। চন্দ্র মিশ্র তাকে ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তীতে চাকরিও পেয়ে যান তিনি।
তবে এ পরিবর্তনগুলো রাতারাতি হয়নি। ওই নারীর পর আরও অনেক ভিক্ষুক এসে যোগ দেন মিশ্রর বেগারস কর্পোরেশনে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর খ্যাতি।
তবে এ বিশাল যাত্রায় মিশ্রর পরিবারও ছিলেন তার সঙ্গে। ২০২২ সালে তার পরিবারের তরফেই তিনজন মিলে ‘বেগারস কর্পোরেশ ‘কে সংস্থা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। সেখানে চন্দ্র মিশ্রের বাকি দুইজন অংশীদার ছিলেন বদ্রীনাথ মিশ্র ও দেবেন্দ্র থাপা। তবে এটি এনজিও নয় বরং ‘ফর প্রফিট কোম্পানি’ হিসেবেই নথিভুক্ত করেছেন মিশ্র। এই কোম্পানির মধ্য দিয়ে ১৪ টি ভিক্ষুক পরিবার রীতিমতো উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। ১২ টি পরিবার ব্যাগ তৈরি করে ব্যবসা করছে, আর দুটি যে মন্দিরের সামনে ভিক্ষা করতেন সেখানেই ফুল আর প্রসাদের দোকান দিয়েছে।
মিশ্র বলেন, এই কোম্পানি খোলার জন্য তিনি সবাইকে মাত্র ১০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে বলেছিলেন। যাতে তিনি ভিক্ষুকদের জীবন পরিবর্তন করতে পারেন। দেড় মাস যাবৎ চলে তার ক্যাম্পেইন। তার প্রথম অনুদান আসে ছত্তিশগড়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে।
প্রাথমিকভাবে ৫৭ জন তাকে টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়েই ভিক্ষুকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন এবং তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেন।
তার এমন উদ্যোগের জন্য এক প্রতিযোগিতায় সেরা উদ্যোক্তার খ্যাতিও পান চন্দ্র মিশ্র।
তবে এই কর্পোরেশনের পাশাপাশি মিশ্রস্কুলও খুলেছেন। যার নাম রেখেছেন ‘স্কুল অব লাইফ।’ যেখানে বারানসি ঘাটে ভিক্ষা করা শিশুদের পড়াশোনা করানো হয়।