‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই,/ আজ আর নেই।’—বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্র সংগীতের বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটির প্রেক্ষাপট আমাদের বর্তমান সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। এখনো শহর জুড়ে অনেক কফি হাউজ আছে। সেখানে বন্ধুরা মিলে আড্ডাও জমাতে যায়। তবে নিজেদের মধ্যে গল্প আর আড্ডার চেয়ে মোবাইল ফোনে ছবি তোলা কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াটাই বেশি গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি বসে বন্ধুরা আর গল্প করে না। কুশল বিনিময় ছেড়ে ডুব দেয় মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপলিকেশনে।
কফি হাউজ ছেড়ে এবার একটু বাড়ি ফেরা যাক। পরিবারের ছোটদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি। অনেকে পত্রিকাতেও লেখেন। কিন্তু আমরা কি কখনো ছোটদের ছেড়ে বড়দের দিকে তাকিয়েছি? আমি ছোটবেলায় দেখেছি বাবা, মা, দাদি, চাচা সবাই এক ঘরে বসে গল্প করতেন। যেসব পরিবারে পারিবারিক বন্ধনটা একটু বেশি মধুর, তারা বসে যেত লুডু নিয়ে। তারপর গুটি কাটাকাটি নিয়ে বেধে যেত সৌজন্য ঝগড়া। এর সবটায় এখন রূপকথার গল্প।
বাস্তবতা হলো একই রুমে বসে আছে সবাই, কিন্তু সবাই হাতে মোবাইল। কেউ ফেসবুকিং করছে। আবার কেউ মুভি দেখছে ইউটিউবে। চোখের সামনে বাড়ির বড়দের মোবাইলে এমন ডুব দেওয়া দেখে ছোটদের মোবাইলের প্রতি আকর্ষণ জন্মানোটা কি স্বাভাবিক নয়?
আমরা প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি। জীবনের প্রথম স্কুল হলো নিজের পরিবার। প্রথম শিক্ষক হলেন বাবা-মা। তবে বাবা-মা বা পরিবারের অন্যরা যদি মোবাইলর প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিতে থাকেন তাহলে সন্তানরা তো তা-ই শিখবে। ছোটদের মোবাইল আসক্তি দূর করার বিভিন্ন উপায় আছে। আমার মনে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বড়দের সবার আগে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিহার করতে হবে।
‘আর ইওর প্যারেন্টস অ্যাডিক্টেড টু ফোনস’ শিরোনামে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক একটি সংস্থা ১ হাজার জন মা-বাবা এবং তাদের সন্তানের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয়, যেখানে প্রতি ১০ জনে ছয় জন মা-বাবা মনে করেন, তাদের সন্তান মোবাইল ফোনে আসক্ত, সেখানে প্রতি ১০ জনে চার জন সন্তান মনে করে যে তাদের মা-বাবা মোবাইল ফোনে আসক্ত। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ কিশোর বয়সি মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইল ফোনে আসক্ত। শুধু তা-ই নয়, তারা তাদের মা-বাবার মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে মুক্তি কামনা করে। এমনকি ৪৫ শতাংশ মা-বাবা নিজেরাই মনে করেন যে তারা মোবাইলে আসক্ত। এই তো গত ডিসেম্বরে জার্মানির হামবুর্গে একদল শিশু মা-বাবার মোবাইল ফোন আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাত বছর বয়সি এমিল আহ্বান জানায়, তোমরা আমাদের সঙ্গে খেলো, স্মার্টফোনের সঙ্গে নয়। সাত বছর বয়সি এমিলের সেই আহ্বান কি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না?
শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা আর মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছেন, সেই খবর কি আমরা রাখি? আমরা শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গঠন নিয়ে চিন্তিত, চিন্তিত শিশুদের সুস্থ বিনোদনের চর্চা নিয়ে। অথচ বই পড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা যে প্রজন্মটি আজ বাবা-মা কিংবা পরিবারের কর্তা হয়েছেন, সেই প্রজন্মটি হয়তো বই পড়া ভুলতে বসেছে।
বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন আহমেদ কিংবা বিদ্রোহী নজরুলের বই পড়ে বড় হওয়া মানুষগুলো আজকাল আর বইয়ের অভাব অনুভব করি না। নিয়ম করে বিটিভির অনুষ্ঠান দেখা, গলা ছেড়ে কোরাস গান করা কিংবা স্কুল-কলেজের খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে আমরা কী নির্দয়ভাবে নিজেদের সঁপে দিয়েছি মোবাইল ফোনের হাতে। কিছু চটকদার খবরের শিরোনাম, টিকটক, পরিচিতদের নিউজ ফিড, কিছু ভিডিও লিংক আর চ্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি নিজেদের জীবন। শিশু-কিশোর-তরুণদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা হয়, আলোচনা হয়। কিন্তু পরিণত প্রজন্মটির বদলে যাওয়া অভ্যাস নিয়ে কেউ কথা বলে না। অথচ পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আমাদের মতো পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল আচরণ ও চর্চা খুব জরুরি। নিজেরাই দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লে কাদের অনুসরণ করবে শিশু-কিশোররা? আসুন, আমরা বড়রা আগে একবার নিজেদের সু-অভ্যাসগুলোর দিকে ফিরে তাকাই। নিজেরা দায়িত্বশীল হলেই না জন্ম নেবে দায়িত্বশীলতার বার্তা ছড়ানোর অধিকার।