আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই গণতন্ত্রের ছবক শোনাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বলা হয়, আপসহীন নেত্রী। তাঁদের লড়াই গণতন্ত্রের জন্য। সব দলই বলছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু সেই মালিকরা কেন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে? বুধবার নয়াপল্টনে গুলিতে নিহত মকবুল হোসেন হত্যাকাণ্ডের দায় কে নেবে? মকবুল-হালিমা দম্পতির একমাত্র সন্তান শিশু মিথিলার আর্তনাদ কে শুনবে?
মকবুলের বিধবা স্ত্রী হালিমা বেগম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতি বোঝেন না। তাঁর স্বামী রাজনীতি করেন না। দু’বেলা ভাত জোটাতে ঘাম ছোটাতে হয় তাঁদের। ১০ বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে যাওয়ার কথা ছিল না তাঁর স্বামীর। তবে বিএনপিকে সমর্থন করতেন। মকবুল কেন নয়াপল্টনে এলেন, তা বুঝতে পারছেন না তিনি। কারা তাঁদের মেয়েকে এতিম করল; তাঁকে বিধবা করল, এর জবাব চেয়েছেন হালিমা। নাম জানতে চাওয়ার পাশাপাশি বিচার দাবি করেছেন তাদের। তবে বুধবার রাতে বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, নিহত মকবুল পল্লবী থানার ৫ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। যদিও তাঁর পদের কথা উল্লেখ করা হয়নি সেখানে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে স্বামীর নিথর দেহের সামনে আহাজারি করা অবস্থায় হালিমার মোবাইলে একটি ফোন আসে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেই ফোন রিসিভ করে হালিমা বলছিলেন, আপনারাই আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছেন। ফোনকারী কে তার পরিচয় হালিমা প্রকাশ না করলেও এটা বোঝা যাচ্ছে, স্থানীয় বিএনপি বা সহযোগী সংগঠনের যে নেতা মকবুলকে নয়াপল্টনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাকেই দুষছিলেন হালিমা।
সভা-সমাবেশের অধিকার সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রয়েছে। তবে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন সমর্থনযোগ্য নয়। পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা না করে আমরা শুধু নিরীহ মকবুলের প্রাণহানি নিয়ে কথা বলব। মকবুলের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার উদিমেরচরে। মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরের লালমাটিয়া এ-ব্লকের ১২ নম্বর লেনে থাকতেন। বাসার কাছে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করেন জুতার চামড়ার ওপরে নকশার কাজ। তাঁর ৭ বছরের মেয়ে মিথিলা আক্তার স্থানীয় মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। অভাবের সংসার হলেও সুখ ছিল তাঁদের। এ নিরীহ মানুষটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কীভাবে আসলো?
প্রচলিত রয়েছে, লাশ পড়লে আন্দোলন চাঙ্গা হয়। এ আন্দোলন চাঙ্গা করতে গিয়ে মিথিলারা এতিম হয়, হালিমারা বিধবা হন। অনেক মায়ের বুক খালি হয়। আর রাজনৈতিক দল তাঁদের শহীদ বলে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিয়ে রাজপথ কাঁপায়; সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলে। মকবুলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর শিশুকন্যা মিথিলা আর্তনাদ করছিল- ‘তোমরা আমার বাবার মুখটা দেখতে দাও। বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমি এখন কার সঙ্গে ঘুমাব? কে আমাকে আদর করবে? আমি এতিম হয়ে গেলাম!’ যে দলের জন্য মকবুল মারা গেলেন, তারা কি মিথিলার পুরো দায়িত্ব নেবে? জানি, আগামী কয়েকদিন কিছু সহায়তা দেবে। পাশে থাকার আশ্বাস দেবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে হালিমা-মিথিলাকে জীবনযুদ্ধে একাই দৌড়াতে হবে।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের তুলনায় অনেক প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর। মকবুলের মতো সাধারণ কর্মী এমনকি আচরণ করেছিলেন যার জবাব বুলেট দিয়ে দিতে হলো? পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে অন্য কারও বুলেটে মকবুলের মৃত্যু হয়ে থাকলে সেই ব্যাখ্যা সংশ্নিষ্ট সংস্থা দেবে। কর্মীদের চাঙ্গা করার নামে বিপথগামী করা নেতাদের দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। ক্ষমতায় এসে ভাগ্য বদলের অসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরলসহজ মানুষের আবেগ সৃষ্টি করে রক্ত ঝরানোর রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণ বয়ে আনে না। ১০ ডিসেম্বর থেকে অন্য কেউ রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এমন অগণতান্ত্রিক বক্তব্য দিয়ে দলকে সাময়িক চাঙ্গা করা যায়। কিন্তু তার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী।
সব ধরনের পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সেই আবেগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে ডেকে নেওয়া কঠিন নয়। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মকবুলের প্রাণহানির দায় সরকার এড়াতে পারে না। কারণ, সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তাদের দায়িত্ব। মকবুলের সন্তানের তথা পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যেন কোনো প্রাণহানি না ঘটে সে দায়িত্ব সরকার ও বিরোধী দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাইকেই নিতে হবে। মিথিলার কান্নার আওয়াজ নীতিনির্ধারকরা শুনছেন কি?