কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের এ মানুষটির সঙ্গে কথা বলে বোঝার উপায় নেই যে তিনি মাত্র দুই ক্লাস পড়েছেন! এমন হাজার হাজার কাঠমিস্ত্রি তো আছে দেশে। তবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর পরিষ্কার হবে—বিশাল মনের অধিকারী জসিমউদ্দিন নামের এই মানুষটি। নিজের অর্থ-সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। কিন্তু তাঁর ‘ধনবান মন’ স্বপ্ন দেখে মানুষকে আলোকিত করার। এলাকার অনেকেই ৩৫ বছর বয়সী এই মানুষটিকে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ বলে ডাকে।
জসিম এলাকার কম বা অর্ধশিক্ষিত মানুষদের বই পড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৬ সালে নিজ বাড়িতে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’ নামে এ পাঠাগারে এখন পর্যন্ত বইয়ের সংগ্রহ প্রায় এক হাজার এবং সদস্য দাঁড়িয়েছে তিন শতাধিক। এখান থেকে বই পড়তে টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় না কাউকে।
স্ত্রী, এক মেয়ে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক ভাই, মাসহ পাঁচজনের পরিবারে তিনি একাই উপার্জন করেন। জসিমের বাবা ছোটবেলায় তাঁদের ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হন।
এলাকার মানুষের প্রিয় ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ জসিমের বিশ্বাস, গ্রামের অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো তাঁর এখানে বইপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে। এ পাঠাগারে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই বই-পত্রিকা পড়তে আসে, কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়।
তাঁর ভাষায়, শুধু স্কুলের ছেলেমেয়েরা না, যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারাও আমার লাইব্রেরি থেকে বই নেয়। এমনকি বয়স্ক ও যেসব মেয়ের কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে তারাও আসে, বই নেয়। আমার মতো খেটে খাওয়া মানুষরাও আসে এখানে বই পড়তে।
নিজের পেশা বা আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়—এ ধরনের ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন কেন? জবাবে জসিম বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার কারণে তা আর হয়নি। সংসারের ভার নিতে হয়। তবে আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন সূত্র থেকে বই সংগ্রহ করে পড়তাম, অন্যকে পড়তে দিতাম। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং একসময় এ রকম একটা লাইব্রেরি গড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এমন চিন্তা থেকেই মূলত কেমন করে যে এটা হয়ে যায় সেটা আমি নিজেও জানি না। এক শর মতো বই নিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু করি। পরে অনেকেই স্বেচ্ছায় আমার এখানে বই কিনে দিয়েছে। আমি তো এখনো কিনছি।’
এই লাইব্রেরি নিয়ে অনেকেই ঠাট্টা-বিদ্রূপও করে। অনেকেই তাঁকে পাগলও বলে। নিজেরই যেখানে ‘দিন এনে দিন খাই’ অবস্থা, সেখানে তিনি মানুষকে বই পড়ান! আর এ নিয়েই বিদ্রূপ। শুধু কি মহল্লার লোকজন? না, তাঁর পরিবারও চায় তিনি যেন আর বই না কেনেন। তাদের এই চাওয়াটাও অন্যায় নয় কিন্তু। কারণ, অভাবের সংসার।
তিনি জানান, যেকোনো রকমের সাহায্য তিনি গ্রহণ করবেন তাঁর পাঠাগারের উন্নতির জন্য। পত্রিকায় কলাম লেখেন এমন কয়েকজনের ই-মেইল ঠিকানা সংগ্রহ করে বই চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কয়েকজন দিয়েছেনও কিছু বই। এর মধ্যে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল রয়েছেন। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন ও নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামালের পক্ষ থেকেও লাইব্রেরির জন্য কিছু বই উপহার পেয়েছেন বলে জানান জসিমউদ্দিন।
জসিমের আবেদন, সামর্থ্যবানরা তাঁকে যেন কিছু বই দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন বইয়ের ভিক্ষুক, মানুষ যেন আমাকে বই ভিক্ষা দেন।’
জসিমউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আজকালের মানুষগুলো শুধু সার্টিফিকেটের জন্য বই পড়ে, কী হবে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে, যদি সঠিক জ্ঞানই না থাকল?’ অভিভাবকরা মনে করেন, বাচ্চারা শুধু পাঠ্য বই পড়লেই যথেষ্ট, কিন্তু তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত জসিমউদ্দিন তাঁর আশপাশের মানুষকে সত্যিকারের আলোকিত মানুষ হিসেবে দেখতে চান।
জসিমের পাঠাগারে বই পড়তে আসা বিভিন্ন বয়সের ও পেশার মানুষ জানায়, আমাদের এই অজপাড়াগাঁয়ে তার পক্ষ থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা খুবই উপকৃত হচ্ছি। আমাদের জানার পরিধি বাড়ছে এবং আমরা এখন সবাই জসিমের দেখানো আলোর পথের যাত্রী। ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক ও লেখক মাসুম বিল্লাহ বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, নিজের কোনো জমি নেই, ব্যাংক ব্যালান্স নেই, সহজ কোনো অর্থের উৎস নেই; কিন্তু অদ্ভুত এক শখ পেয়ে বসেছে কাঠমিস্ত্রি জসিমউদ্দিনকে। বর্তমান সমাজে এটি বিরল।
জসিম সম্পর্কে জানার পর কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাফ্ফারা তাসনীন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ ধরনের মানুষদের উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করা উচিত। আমি জসিমের লাইব্রেরিতে যাব এবং অবশ্যই সাধ্যমতো সেখানে সহায়তা করব।’
আলোর ফেরিওয়ালা জসিম খুব নীতিনিষ্ঠও। জানা গেল, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের ভাতা চালু থাকলেও তার ছোট ভাইয়ের নাম সেই তালিকায় নেই। কেউ একজন ভাতাপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী তালিকায় তাঁর ভাইয়ের নাম তালিকাভুক্ত করে দেবেন জানিয়ে বললেন, সে জন্য কিছু নগদ দিতে হবে। সংসারের চতুর্দিকে অভাব, তবু আলোর ফেরিওয়ালা জসিম সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। বলতেই হয়, শাবাশ জসিম!