বরিশালের বর্তমান মেয়রের সঙ্গে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদটির কোনো বিরোধ আছে কিনা- এ প্রশ্নই এখন সামনে চলে এসেছে। পরপর দুটি ঘটনায় মেয়র এবং ইউএনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ায় এ ভাবনা আরও জোরালো হচ্ছে। সব শেষ, সারাদেশের উত্তাপহীন জেলা পরিষদ নির্বাচনের দিন ইউএনওকে ধমকানো মেয়রের একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানকে ধমকাচ্ছেন। শুধু ধমক দিয়েই ক্ষান্ত হননি; ইউএনওকে ‘স্টুপিড’ বলে গালি দিয়েছেন।
সমকালে ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে নগরীর জিলা স্কুল কেন্দ্রে দলবল নিয়ে প্রবেশ করেন মেয়র। সেখানে দায়িত্বরত ইউএনও তাঁকে একা যেতে অনুরোধ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইউএনওর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে তাঁকে ‘স্টুপিড’ বলাসহ অশালীনভাবে ধমকান মেয়র।
মেয়র শুধু দলবল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেননি; তাঁর সঙ্গে থাকা একজন এ ঘটনা ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচারও করেছেন। দুটি ঘটনাই নির্বাচনী আচরণবিধিসম্মত নয়। এখানেই আপত্তি তুলেছেন দায়িত্বপালনরত ইউএনও।
এর আগে গত বছরের ১৮ আগস্ট রাতে মেয়র সাদিকের অনুসারীরা সিটি করপোরেশনের কর্মী পরিচয়ে সদরের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের স্থাপন করা ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ঢোকেন। তখনকার ইউএনও মুনিবুর রহমান বাধা দিলে তাঁর বাসভবনে হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। সে সময় মেয়র ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সদর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও মুনিবুর রহমান বাদী হয়ে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে প্রধান এবং ২৮ জনের নাম উল্লেখসহ ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা করেন। সে সময় এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরিশাল আওয়ামী লীগের বিভক্তি প্রকাশ্যে আসে। সারাদেশের মাঠ প্রশাসনের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
মামলার পর মেয়রের অনুসারীরা চাপে পড়েন এবং মেয়র কিছুদিনের জন্য চুপ হয়ে যান। এমনকি মেয়রকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মেয়রের বাসার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যদের অবস্থান নিতেও দেখা গেছে। পরিস্থিতি সামলাতে শেষ পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়। মামলার আসামি প্রত্যাহার করা হলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে। এ থেকে ধারণা করা যায়, আমলারা মামলা আপাতত চেপে রাখলেও সময়মতো দাঁড় করিয়ে দিতে অঙ্গীকার করেছেন।
মেয়রের সঙ্গে বিবাদ সে সময়ে মিটলেও মূলত এর পর থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সাদিক আবদুল্লাহর দূরত্ব চলছে। দূরত্ব যে চলছে, তার সর্বশেষ নজির দেখা গেল জেলা পরিষদের নির্বাচনের দিন। এর আগে বরিশাল সদর ইউএনওর বাড়িতে হামলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছিল, তা নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। এখন আবার সেই একই বরিশালে এমন ঘটনা ঘটল। এবারের ঘটনায় অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিক্রিয়া এখনও জানা যায়নি।
একটা সময়ে আমলা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সৌজন্য ও পারস্পরিক সম্মানবোধ ছিল। এখন সে জায়গায় এক ধরনের পরিবর্তন চলে আসছে বলে দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রাজনীতিবিদের কথাই শেষ কথা- এমন ধারণা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের বাইরে গিয়ে, এমনকি রাজনীতিবিদদের ভাগ্যনির্ধারণী নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমলাদের ভূমিকা বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
অতএব, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক সমস্যাটির সমাধান হতে পারে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া।