শুক্রবার ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   শুক্রবার ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ



বরিশাল ও ভোলায় একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা
প্রকাশ: ১২ আগস্ট, ২০২২, ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

বরিশাল ও ভোলায় একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা

আবু সাঈদ :

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ-দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এই হত্যাকাণ্ড চলে। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে বরিশাল ও ভোলা গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

বরিশাল

ত্রিশ গোডাউন কম্পাউন্ড বধ্যভূমি
বরিশাল জেলার ত্রিশ গোডাউন কম্পাউন্ডের এলাকা থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত প্রায় ২০ বিঘার মতো ধানের জমির পুরো এলাকাটাই ছিল বরিশালের মূল গণকবর ও বধ্যভূমি এলাকা। পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে নিয়ে এসে এ এলাকায় হত্যা করে। পরে তাঁদের লাশ কখনো মাটিচাপা আবার কখনোবা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

কীর্তনখোলা বধ্যভূমি
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে গানবোট ও হেলিকপ্টারে করে বরিশালে প্রবেশ করে। সেনাসদস্যরা বর্তমান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উল্টো দিকের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনি দখল করে নেয়। সেখানকার একাধিক ভবনে স্থাপন করে ক্যাম্প ও টর্চার সেল। কীর্তনখোলার তীরবর্তী এই ক্যাম্প থেকেই ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলায় অপারেশন চালাত পাকিস্তানি বাহিনী। ক্যাম্পসংলগ্ন কীর্তনখোলার শাখা সাগরদী খালের তীরে তিনটি বাংকার তৈরি করে বসানো হয় পাহারা। টর্চার সেলে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ নারী-পুরুষকে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হতো খালে। খাল ধরে জোয়ারের সময় লাশ গিয়ে কীর্তনখোলা নদী হয়ে পাশের নদীতে পড়ত।

পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহরে প্রবেশ করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। তারা বরিশালে বর্তমান পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে ঘাঁটি স্থাপন করে। এখানে তারা নির্যাতনকক্ষও তৈরি করে। এখানে বহু মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। ছবি: সংগৃহীত

গৌরনদী বধ্যভূমি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করে বরিশালের গৌরনদীর পানিতে ভাসিয়ে দিত। এ রকম ১০-১৫টি লাশ লাল চাঁদ ফকির ও আরও অনেকে মিলে মাটিচাপা দেন বলে জানান। এ ছাড়া গৌরনদী কলেজের পেছনের পুকুরে তর্কি দেওয়ানের দুই ভাইকে গলা কেটে হত্যা করে পশ্চিম পাশে কবর দেওয়া হয়। আব্দুর রশীদ ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি জানান, স্বাধীনতার পর এখানে ১০-১২টি মাথার খুলি পাওয়া যায়।

কেতনারকোলা বধ্যভূমি
বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহার গ্রামের কেতনারকোলায় পাঁচটি গর্তে যথাক্রমে ৮৫, ৬০, ৪৬, ৪০ ও ৩০টি লাশ পুঁতে রাখা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী বিমল পাত্র ও অন্যরা জানান। এখানে বীরেন্দ্রনাথ ঢালীর ভিটায় ৪টি ও অনিল ব্যাপারীর বাড়িতে ৪৬ জনের আরেকটি গণকবর আছে। এ গণকবরগুলোতে নারীদের লাশই বেশি ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা বিশ্বের গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা বিশ্বের গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

কলসকাঠি বাজার বধ্যভূমি
পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৮ মে ক্যাপ্টেন হানিফের নেতৃত্বে বরিশালের হিন্দুপ্রধান এলাকা কলসকাঠি আক্রমণ করে। ১০০ পাকিস্তানি সেনা দুটি লঞ্চে করে এসে কলসকাঠি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে কয়েক শ হিন্দুকে কলসকাঠি বন্দরে একত্র করে। এরপর শুরু করে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা। কলসকাঠির খয়রাবাদ-ভুলাতলা নদীর পানি হয়ে ওঠে লালে লাল। ওই দিন পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ৮৭ জনকে হত্যা করেছিল।

বদিরপুর পুল বধ্যভূমি
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থানার সাজেদপুর গ্রামের বদিরপুল এলাকায় ছিল বধ্যভূমি। পাকিস্তানি সেনারা এই পুলের নিচে বহু লোককে লাইনে করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯ ডিসেম্বর এখানে শত শত নরকঙ্কাল ও মাথার খুলি দেখা গেছে।

ওয়াপদা কলোনি বধ্যভূমি
ভোলার ওয়াপদা কলোনি ছিল পাকিস্তানিদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে এমন কোনো রাত ছিল না যে ১০-১৫ জন বাঙালিকে হত্যা করা হতো। অধিকাংশকেই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। এই কলোনির রেস্টহাউস ছিল পাশবিকতার কেন্দ্রস্থল। এখানে রাতের পর রাত ক্যাপ্টেন মুনীর হোসেন এবং সুবেদার সিদ্দিক অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে। ক্যাপ্টেন মুনীর লুটপাট করে টাকা ও সোনা-দানা নিজে হাতিয়ে নিয়েছে আর তার সহযোগীরা নিয়েছে অন্যান্য জিনিস। আর এ কাজে সহযোগিতা করেছে শান্তি কমিটি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ-দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তার খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ-দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তার খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

লতিফ মাতব্বর বাড়ি গণহত্যা
১৯৭১ সালে এখানে ১০-১২ জন মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

চরগাজী গ্রাম গণহত্যা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী গানবোটে করে এই গ্রামে আসে। এখানে অসংখ্য নারীকে নির্যাতন করে তারা। কয়েকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।

ঘুইঙ্গার হাট গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবরে পাকিস্তান বাহিনী ঘুইঙ্গার হাটে আসে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করার ফলে অনেক মানুষের জীবন বেঁচে যায়। তবুও সাতজন মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

ভোলা
খাসেরহাট গণহত্যা
ভোলার দৌতলখান উপজেলায় ১০ অক্টোবর উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের খাসেরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনার কথা রাজাকার বাহিনী জানতে পারে। কিন্তু বুঝতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

বোরহানউদ্দিন বাজার খালপাড় গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বোরহানউদ্দিন বাজারে আক্রমণ করে বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। অতর্কিত হামলায় বাজারে মানুষ নানা দিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। তাদের গুলিতে অসংখ্য মানুষ আহত ও নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীর হিসেবে পাওয়া যায় ১৩ জন মানুষের নাম।

সতীশ চন্দ্র হাওলাদার বাড়ি গণহত্যা
মাগন চন্দ্র দাসের ছেলে শহীদ শ্রীধারাম দাস ও তাঁর ছেলে শহীদ শংকর চন্দ্র দাস, হরেন্দ্র চন্দ্র দাসসহ অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়।

চরফ্যাশন গণহত্যা
স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাধা গোবিন্দ দেবনাথ, বিনোদ বিহারী মজুমদারকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি ক্যাম্প ভোলা ওয়াপদা কলোনিতে। সেখানে তাঁদের অনেক দিন অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

নীলকমল গণহত্যা
চরফ্যাশন উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকারের অবস্থান ছিল বেশ শক্তিশালী। এখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন পরিবারগুলোর ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, সম্পাদিত আবু সাঈদ; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ্বাস; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ডা. এম এ হাসান; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, চতুর্থ খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল-সুকুমার বিশ্বাস ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, ভেলা জেলার ১৯৭১: গণহত্য-নির্যাতন, রেহানা পারভীন।

*বরিশাল ও ভোলার গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: [email protected]

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া