রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্নতর হয় চিন্তাশক্তির প্রখরতা, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তবে নেতৃত্ব বিষয়ে ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের বিশ্লেষণটি স্বতঃসিদ্ধ ও অকাট্য বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে একজন মানুষের নেতা হওয়ার জন্য অনুসরণযোগ্য সব উপাদান। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রস্টের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু সাতটি বাক্যে নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে—‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাঁকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তাঁর মধ্যে অবশ্যই নীতি-আদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা। ’ রাজনীতিতে নেতৃত্বের এই সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ আসলে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাপ্তি ছিল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় ৩১ বছর। এই সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করে তিনি একজন সাধারণ কর্মী থেকে দলের এবং বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়েছেন। তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
আসলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্বের যেসব গুণ আমরা দেখতে পাই তাতে শুধু নেতা হওয়া নয়, একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একেকটি গুণ নিয়ে একেকটি গবেষণাগ্রন্থ রচিত হতে পারে। কিন্তু এই নিবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ কিছু গুণের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরার জন্য।
ছাত্রাবস্থায়ই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ক্যারিসমেটিক সেনস অব পলিটিকস বা ক্যারিসমেটিক রাজনীতি বোধের প্রকাশ দেখা যায়। এ কারণেই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময়ই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টিতে আসেন। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্ব বিকশিত হয় অসাধারণ সব গুণের কারণে। যেমন—তিনি ছিলেন সাহসী, কৌশলী, সৎ, ত্যাগী, ধর্মনিরপেক্ষ, অনলবর্ষী বক্তা ও যোগাযোগকারী, ভিশনারি, মানবিক ইত্যাদি। এসব গুণের কারণেই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের ক্যারিসমেটিক নেতাদের একজন। টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় বলা হয়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অর্ধশতাব্দীজুড়ে যাঁরা ক্যারিসমেটিক হিসেবে আলোচিত তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওয়াহেরলাল নেহরু। এই তালিকায় সম্ভবত আরেকটি নাম যোগ হতে যাচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ’ বিশ্বের খ্যাতনামা এনসাইক্লোপিডিয়াডটকমে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ক্যারিসমেটিক নেতা শেখ মুজিব তৃতীয় বিশ্বে উপনিবেশবিরোধী নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ’ কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে সাহস ও ব্যক্তিত্বের বিশালতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়সম উচ্চতার একজন মানুষ। আর তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর মাঝে হিমালয় দেখেছিলেন। ভারতের মণিপুর ও ঝাড়খণ্ডের সাবেক গভর্নর ভেদ মারওয়া, যিনি লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব হিসেবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সঙ্গী হন, তিনি বলেছেন, ‘আমার চাকরিজীবনে জওয়াহেরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীসহ অনেক বিশ্বনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিব সবচেয়ে ক্যারিসমেটিক ব্যক্তিত্ব। ’ (বাসস পরিবেশিত খবর)।
বঙ্গবন্ধুর সাহসের কথা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনেক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি। লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সদ্যঃপ্রয়াত সাইমন ড্রিং ‘ট্যাংক ক্র্যাশ রিভল্টস ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে (৩০ মার্চ ১৯৭১) প্রকাশিত প্রতিবেদনে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তার সঙ্গে আত্মগোপনে যেতে অস্বীকৃতির কথা তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, ‘একজন শুভাকাঙ্ক্ষী শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিফোনে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি উত্তরে বলেন, আমি যদি আত্মগোপনে চলে যাই ওরা আমাকে খোঁজার জন্য পুরো ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে। ’ বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। ‘হি টেলস ফুল স্টোরি অ্যাবাউট হিজ অ্যারেস্ট অ্যান্ড ডিটেনশন’ শিরোনামে ১৮ জানুয়ারি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় নিয়াজির জেলার বন্দিদের দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার কথা। এ জন্য কারাগারে তাঁর সেলের অদূরেই কবর খোঁড়া হয়। বঙ্গবন্ধু এই হত্যা পরিকল্পনার কথা জেনেছেন পরে। বঙ্গবন্ধু যেটা জানতেন সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায়ে যেকোনো সময় তাঁর ফাঁসি হতে পারে। তাই কারা তত্ত্বাবধায়ক তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি শুরু করলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তুমি যদি ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার জন্য আমাকে নিতে চাও, তাহলে আমাকে প্রার্থনা করার জন্য কয়েক মিনিট সময় দাও। ’
বঙ্গবন্ধুর জীবনে সততাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। সততার শিক্ষা তিনি পেয়েছেন পরিবার থেকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনে এই সততার অনুশীলন করেছেন। রাজনীতিতে কখনো মিথ্যা, ভণ্ডামির আশ্রয় নেননি। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘আনডিসপুটেড লিডার অব দ্য বেংগলিস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘নো ওয়ান অ্যাকিউসড শেখ মুজিব অব ফলস মডেস্টি। ’
বঙ্গবন্ধুর মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার মোহনীয় শক্তি ছিল। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। ১৯৪১ সালে কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে তিনি দুইবারের মধ্যে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার কারণে। তিনি শুধু ভালো বক্তা নন, ভালো একজন যোগাযোগকারীও। যোগাযোগবিদ্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি প্রকৃত অর্থে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে সহজ ভাষা ব্যবহার করতেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত। ভালো বক্তৃতা ও যোগাযোগকারীর গুণ থাকার কারণে তিনি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য সম্পর্কে ১৯৭০ সালের ৯ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদনটিতে একজন কূটনীতিকের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এমনকি আপনি যদি তাঁর (শেখ মুজিব) সঙ্গে একাকী কথা বলেন মনে হবে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে তিনি ৬০ হাজার মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতা করছেন। ’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উপাদানে পরিণত হয়। ইতিহাসের পর্যবেক্ষক ব্রিটিশ জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের ৪১টি সেরা ভাষণ সংকলিত করে ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিসেস দ্যাট ইনসপায়ারড হিস্টোরি’ নামের একটি গ্রন্থ লিখেছেন। এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। জ্যাকব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একটি বাক্যকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে গ্রন্থিত করেছেন এভাবে—‘রিমেম্বার অনস উই হ্যাভ শেড ব্লাড, ইউ উইল নট হেজিটেট টু শেড মোর। বাট উই উইল ফ্রি দ্য পিপল অব দিস কান্ট্রি, ইনশাআল্লাহ। ’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী ও কৌশলী। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন পরিচালনায় ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী। তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, ধর্ম, ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি যুক্ত করে তা স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেন। তিনি এতটাই কৌশলী ছিলেন যে গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন করেছেন এবং ১৯৭১ সালের মার্চের আগ পর্যন্ত আন্দোলনকে সহিংস রূপ নিতে দেননি। ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় এক পাকিস্তানি সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, নির্বাচনের পর ওই এলএফও আমি ছিঁড়ে ফেলব।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবিক গুণের অধিকারী। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াকালীন তাঁর গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ পরিচালিত সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি চাল তুলে ছাত্রদের বই, পরীক্ষার ফি, জায়গিরের খরচ জোগান দিতেন। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের কাউন্সিলর। লঙ্গরখানা খুলে মানুষকে খাইয়েছেন। বেকার হোস্টেলে দুপুরে ও রাতে যে খাবার বাঁচে তা বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দিয়েছেন। জনগণের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রবল। রাজনীতিতে তিনি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমি তাদের অত্যধিক ভালোবাসি। ’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এমনি একজন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী নেতাকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাঙালির জাতির কপালে এঁকে দেওয়া হয় কলঙ্কতিলক। আর তাই ভারতীয় সাহিত্যিক ব্রিটিশ নাগরিক বাঙালিদের আখ্যায়িত করে ‘ইনসিডিয়াস বেংগলি’ হিসেবে। আর জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডথ বলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যার পর কোনো বাঙালিকে বিশ্বাস করা যায় না। ’