গত রোববার বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দ্বীপজেলা ভোলায় যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল, তা যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত; তেমনই অগণতান্ত্রিক। উদ্বেগজনকও বটে। দেশজুড়ে অব্যাহত লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ভোলা জেলা বিএনপি সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিল ওই দিন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের করার সময় পুলিশ ও নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। পুলিশের গুলিতে সেদিনই নিহত হন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী আবদুর রহিম মাতব্বর। ওই দিন সংঘর্ষে গুরুতর আহত ভোলা জেলা ছাত্রদল সভাপতি মো. নুরে আলম ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার মারা গেছেন। এ ছাড়া পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপে আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় তাদের ২০ জন সদস্য আহত হয়েছেন।
পুলিশ যে কথাই বলুক না কেন; বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ-ফুটেজ এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট- বিএনপির মিছিলে পুলিশ বাধা না দিলে পরিস্থিতির এমন অবনতি হতো না। ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি ১ আগস্ট দেশব্যাপী গায়েবানা জানাজা এবং ২ আগস্ট প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। বৃহস্পতিবার ভোলায় পালিত হয়েছে হরতাল। ঢাকার নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাজা শেষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার গুলি করে আন্দোলন দমন করতে চায়। তবে তা সম্ভব হবে না। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটানো হবে। অন্যদিকে, পুলিশ ওই ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির ৬০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে দুটি মামলা করেছে। তাদের মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ জনকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন ঘটনা অভিনব নয়। অতীতেও বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশে পুলিশের হামলা, গুলির ঘটনা ঘটেছে। তাতে আহত-নিহতও হয়েছেন অনেক। এটা যে একটি রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি- সে কথা না বললেও চলে। অতীতের মতোই ঘটনার পুরো দায় পুলিশ এখন বিএনপির কাঁধে চাপাতে চাচ্ছে। পুলিশ যদি বিএনপির মিছিলকে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যেতে বাধা না দিত, তাহলে তা শান্তিপূর্ণভাবেই হয়তো শেষ হতো- এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বস্তুত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুলিশের আগ বাড়িয়ে ভজকট লাগানোর নজির আগেও অনেকবার দেখা গেছে।
প্রশ্ন হলো- পুলিশ বিএনপির মিছিলে কেন বাধা দিল? বাংলাদেশের আইনে কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিং করা কি বেআইনি কাজ? আমাদের সংবিধানে দেশের সব নাগরিককে সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ সুতরাং পুলিশ ভোলার জনগণের নাগরিক অধিকার সেদিন ক্ষুণ্ণ করেছে। তা ছাড়া ভোলা জেলা পুলিশ পূর্বাহেপ্ত এমন কোনো গণবিজ্ঞপ্তি দেয়নি- ‘কোনো ধরনের মিছিল করা যাবে না।’ তাহলে সমাবেশ শেষে মিছিল বের করে বিএনপি তো আইন ভঙ্গ করেনি। বরং পুলিশই মিছিলে অহেতুক বাধা দিয়ে বেআইনি কাজ করেছে।
বিএনপির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়- ‘দলটি মাঠে নামে না’। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও এই বলে কটাক্ষ করে থাকেন- বিএনপির মাঠে নেমে আন্দোলনের মুরোদ নেই। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, সরকার তাদের মাঠে নামতে দেয় না। অভিযোগটি যে অমূলক নয়; ভোলার ঘটনা তার প্রমাণ। এই তো সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, তাহলে নেতাদের ডেকে তিনি চা খাওয়াবেন। তাঁর এ কথায় জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল- এবার হয়তো দেশের রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সহাবস্থানের বাতাস বইতে শুরু করবে। কিন্তু সপ্তাহ না পেরোতে পুলিশ ভোলায় যে ঘটনা ঘটাল, তাতে প্রধানমন্ত্রীর কথার মর্যাদা কতটা রক্ষা পেল- সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তা ছাড়া এমন তো নয়, ভোলায় বিএনপির ওই একটি মিছিল সফলভাবে সমাপ্ত হলে আওয়ামী লীগ সরকারের গদি উল্টে যেত। তাহলে কেন এই অসহিষুষ্ণতা; কেন এই অগণতান্ত্রিক আচরণ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় লিখেছেন- ‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।’ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে আমরা কবিগুরুর ওই কবিতার লাইনের সাযুজ্য প্রায়ই লক্ষ্য করি।
ভোলার ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত দুই মামলার আসামির সংখ্যা ৬০০। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে আর মাঠে না নামতে পারে, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। পুলিশ এখন যাকে খুশি ওই মামলার ‘অজ্ঞাত’ আসামি হিসেবে চালান করে দিতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা বলি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আমার এলাকা মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে একই রাতে প্রায় ১৫ মাইল দূরত্বের নৌকা মার্কার দুটি ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার অভিযোগে মামলা হলো। একটি মামলায় আসমি ৪৭ জন, আরেকটিতে ৬২। ঢাকায় অবস্থান করা সত্ত্বেও ওই দুটি মামলাতেই আমাকে আসামি হিসেবে ‘মর্যাদা’ দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি কোর্টে উঠলে আমাদের আইনজীবী ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন- ‘ইউর অনার, আমরা এই আদালতে প্রায় ২০০ আইনজীবী আছি। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ কারও নাম জানি না; পিতার নাম-ঠিকানা তো দূরের কথা। অথচ এই মামলা দুটি যিনি করেছেন, তিনি রাতের অন্ধকারে সব লোককে চিনে ফেললেন। এমনকি তাদের পিতার নাম, গ্রামের নামও জেনে গেলেন! সুতরাং এই মামলা একটি ভিত্তিহীন ও সাজানো মামলা।’ ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জামিন দিয়েছিলেন। পরে পুলিশ তদন্ত করে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ায় একটি অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা পাই।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক মামলাগুলো এমনই হয়। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা করতেই পারে। কিন্তু পুলিশ যখন আগ বাড়িয়ে রাজনৈতিক দলের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কথা ওঠে তখনই।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্নেষক