সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গত ২০ মার্চ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ‘অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক বৃদ্ধির হোতাদের আইনের আওতায় আনার’ দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠত এই দলটি এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট শরিক। বিক্ষোভে দলটির সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তাদের ঠিকানা হোক জেলখানা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার হুঁশিয়ারির পরও প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পিছুটান রহস্যজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেই আমদানি করা পণ্যের হিসাব-নিকাশ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তালিকা নিয়ে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
২৩ মার্চ রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই বোর্ড রুমে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ, বাজার পরিস্থিতি ও বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। ওই সভায় গরুর মাংসের দাম নিয়ে খোদ প্রশ্ন তুলেছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তার ভাষ্য, দুবাইয়ে গরু উৎপাদন হয় না। করা হয় আমদানি, এরপরও গরুর গোশতের কেজি ৫০০ টাকা, বাংলাদেশে গুরু পালন করা হয়, এরপরও কেন ৭৫০ টাকায় কিনতে হবে? গরু ও পোল্ট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
বাজারে গিয়েই ভুক্তভোগীরা মন খারাপ করছেন। কারণ দেশে হুট করে দফায় দফায় বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। মাছ, গোশত, ডাল, তেল, চিনি ও ডিম দাম বাড়ছেই। বাসায় রান্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় এলপি গ্যাসের দামও বেড়েছে। এসবের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। উদাসীন বাজারব্যবস্থা ও অব্যবস্থাপনার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিন দিন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও আয় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের। যার ফলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে।
অনেক সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। এ কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারা। রোজকার চাহিদা পূরণ করতে তাদের গুনতে হচ্ছে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম। দেশের ও সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থাকে পুঁজি করে একদল অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে চলছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করেও এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে পারছেন না; যার ফলে দুই থেকে তিনগুণ দাম বেশি দিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ পরিলক্ষিত হয়। যেমন চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এবং পণ্যের জোগান সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে বাজারে ক্রেতার বৃদ্ধি ঘটে। শুরু হয় পণ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা, ফলে মূল্যবৃদ্ধি পায়। দেশে দিন দিন যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাড়তি জনসংখ্যার ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদনঘাটতির কারণে জোগান অপ্রতুল। যাতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়।
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে না চাষাবাদের জমি ও কৃষিশিল্পের কাঁচামাল। যার ফলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধিতে মজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানি, অসাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা মোক্ষম। তা ছাড়া আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর। অবাধে জমি ভরাট ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না দেওয়ার ফলে অনেকেই কৃষিকাজ থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছেন। যার ফলে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ে ব্যাঘাত ঘটছে।
দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বরাবরই সরবরাহকারীদের মধ্যে কার্টেল বা জোট গড়ে উঠতে দেখা যায়। কিছুসংখ্যক সরবরাহকারী একজোট হয়ে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখার যে জোট গড়ে তোলেন, সে প্রক্রিয়ার নামই কার্টেল। এটা আমাদের স্বাভাবিক আইন-কানুনের পরিপন্থী। আমাদের আইনে বলা আছে, কোনো গোষ্ঠী নিজেরা সুবিধা নেওয়ার জন্য খুশিমতো বাজার ম্যানুপেলেট করতে পারবে না। কৃত্রিমভাবে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ বা পণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে পারবে না। আমাদের আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ।
দুঃখজনকভাবে এই আইনের বাস্তবায়ন খুব কমই দেখা যায়। রোজা এলে দেখা যায়, আমাদের প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট নামিয়ে দোকানে দোকানে গিয়ে তদারকি করে। কোথাও অতিরিক্ত মূল্য চাওয়া হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। দোকানগুলোতে মূল্যতালিকা রাখা হলো কি না এবং সে অনুযায়ী দাম রাখা হচ্ছে কিনা, তা দেখে এবং কিছু জরিমানা করে।
বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতি বলতে গেলে কাজে লাগে না। আসল ব্যাপারটা ঘটে সরবরাহের পর্যায়ে। এক ডজন আমদানিকারক যদি একসঙ্গে হাত মেলান, তাহলে সহজেই তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে পারেন। এটাই সরকারকে দেখতে হবে। যারা আমদানি করেন, তাদের আমদানি ব্যয় কেমন এবং তারা কোনো কারসাজি করছেন কিনা, বেআইনি কিছু করছেন কিনা সেটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
বৈশ্বিক বাস্তবতাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হয়েছে, দেশে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, কাঁচামালের দাম বাড়ছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ হচ্ছে বা হবে হবে অবস্থা চলছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমদানিকারকদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। অনেকে সলিড অ্যাসেট কিংবা ফরোয়ার্ড মার্কেটে অপরিশোধিত তেলের মতো পণ্য ধারণ করার দিকে ঝুঁকছে। এসব কারণে অগ্রসর অর্থনীতিগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি ওপরের দিকে রয়েছে। এসব মাথায় রেখে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, অসাধু ব্যবসায়ীর দল সুযোগ বুঝে হঠাৎ পণ্য গুদামে মজুত করার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পণ্যের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে এবং অল্প অল্প করে মজুত পণ্য বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এই সময়ে চোরাকারবারিরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় দেশি পণ্য বিদেশে পাচার করে দিলে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি হয়, যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
কালো টাকার প্রভাবে সমাজের একশ্রেণির লোকের পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের তুলনায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। জাতীয় অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নীতি শিথিল হলে এবং আমলাতন্ত্র দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এর পরিণতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। তাছাড়া দুর্নীতি, অবৈধ চাঁদাবাজির প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যের ওপর।
পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বিপাকে ফেলেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোক মধ্যম থেকে নিম্ন আয়ের। পণ্যের দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে তাদের ওপর। অধিক দামে পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা দেশের অধিক মানুষেরই নেই। যার ফলে বাধ্য হয়ে কমাতে হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন বাজার খরচ। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে গেলে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে কমে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মান। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য বাড়তি অর্থের জোগান দিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েন, যার ফলে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়।
এখনই সময় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের। সঠিক বাজার ব্যবস্থা ও নীতিমালা নির্ধারণের মাধ্যমে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে হবে; যাতে তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। এর জন্য দরকার সরকারের নীতিমালা। পণ্যের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে।
কৃষি ও শিল্পজাত খাতের কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া ভূমি সংস্কার নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষকদের চাষাবাদে আগ্রহী করতে হবে। কৃষকদের কৃষিকাজের ন্যায্যমূল্য প্রদান করতে হবে। অপরিকল্পিত জমি ভরাট বন্ধ করে খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরকারকে বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করতে হবে এবং পণ্যদের দাম নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার ব্যবস্থা করতে হবে। কালোবাজারি ও চোরাচালানি রোধ করতে হবে।