ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী যুক্তিযুক্ত :বাতিলের কোন বিকল্প নাই
প্রকাশ: ১৯ মার্চ, ২০২৩, ২:২৬ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
মামুনুর রশীদ নোমানী :
ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের আইনগুলো ছিল শোষণ, নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক। কারণ, শাসন ব্যবস্থাকে পোক্ত করতেই ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী আইন পাস করত। পাকিস্তান আমলেও একই প্রয়োজনে স্বৈরাচারী পন্থায় নিপীড়নমূলক আইন পাসের ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরও ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের নিয়ম অনুযায়ী অধিকাংশ আইন করা হয়- যা দুর্ভাগ্যজনক।
আমরা এখন দুর্ভাগ্য সময়ে অতিবাহিত করছি। বহুল বিতর্কিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সাংবিধানিক অধিকার সংকুচিত করেছে। ক্ষমতাশীনদের এখন প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে এই বিতর্কিত আইনটি। দেশ ও বিদেশের সকলেই এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এখন একটাই দাবী উঠছে সেটি হল সংশোধন নয় সরাসরি বাতিল চাই।
আইনটি নিয়ে যখন জাতিসংঘ থেকে শুরু করে দেশ ও বিদেশের সরকার ও সংস্থাগুলোর মধ্য আলোচনা হচ্ছিল তখন এ আইনে নয় মাসের অন্তঃস্বত্তা চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে আটক অতঃপর জামিন বিষয়ে সর্ব মহলে এ আইনের ব্যবহার নিয়ে আবার সরব হয়ে উঠছে দেশ ও বিদেশের সচেতন মহল।
বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক, ও বাকস্বাধীনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং ৩৯ (২-ক) এ প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়িত করতে পারে। তথ্য জানা যেহেতু অধিকার- এই অধিকারের ইতিবাচক ব্যবহার দরকার। কারণ তথ্য জ্ঞান সৃষ্টি করে। জ্ঞান মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কট দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অথচ আজকাল অনলাইন মাধ্যমে সত্য বলা অনেকটাই কঠিন। চোরকে চোর বলা যাবেনা।
একজন চোর চুরি করতে গিয়ে আটক হলো। ঐ চোরের বিরুদ্ধে কেউ দু কলম অনলাইন মাধ্যমে লিখলে মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। কারন চোরের চুরি সম্পর্কে লিখলে চোরের ইজ্জত যায়।
কেন কি কারনে এই কালো আইনটি করা হয়েছে তা সকলেরই জানা। যখন যার ওপর এই আইনটির প্রয়োগ হয় তখনই তারা সোচ্চার হয়। আমি মনে করি এই আইনটি সকলের জন্য বিষফোঁড়া।
আজ আমি। কাল মাহি পরশু কে? এ প্রশ্ন সকলের মাঝে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক হয়রানির পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও অনেকে গোষ্ঠীগত ও উপদলীয় দ্বন্দ্বে এই হাতিয়ারের অপপ্রয়োগের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের পাচঁ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন এ পাচঁ বছরে আইনটি দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।
আইনটি বাতিলের জন্য সম্পাদক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অনেক রাজনৈতিক দল দাবি করলেও সংশ্লিষ্টরা নিরব।
সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর আইনটি কার্যকর করার পর থেকে সাংবাদিকসহ সত্যবাদীদের ওপর এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।দমন নিপিড়নের মূল হাতিয়ার এই কালো আইন বিষয়ে সুশীল সমাজ মনে করছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। এই আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করলেই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে। দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব মামলা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
দণ্ডবিধির ৫০০ থেকে ৫০১ ধারায় এই মানহানির বিচার হয়। প্রত্যেক ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড। সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে, তবে পরিমাণ উল্লেখ নেই।
একই অপরাধে একই সঙ্গে দুই আইন বলবৎ থাকাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করছেন আইনজ্ঞরা। দণ্ডবিধিতে মানহানির শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, একই ধরনের অপরাধে দণ্ডবিধি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেছেন, একই অপরাধের জন্য দুটি আইন পাশাপাশি চলতে পারে না।
দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার আরও অসামঞ্জস্য রয়েছে। মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৫০০ থেকে ৫০২ ধারার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক করা যাবে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
দণ্ডবিধির তিন ধারার অপরাধ বিচার হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির মামলার বিচার হয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুযায়ী, মানহানির ক্ষেত্রে যিনি সংক্ষুব্ধ তিনি ছাড়া অন্য কেউ মামলা করতে পারবে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষে কেউ মামলা করলেই সেটি গ্রহণ করা হয়।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, গ্রেপ্তারের অবাধ ক্ষমতা দেওয়ায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানহানির মামলায় সাংবাদিক ও অন্যদের যখন-তখন গ্রেপ্তার করছে। আবার ট্রাইব্যুনালও এসব মামলা আমলে নিচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তা দূর করে এটিকে আরও ভালো করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) সমস্যা দূরীকরণে আলোচনা চলছে, সেখানে সব পক্ষের কথা শোনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন না করে পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজ।
আমরা এই বিতর্কিত সংবিধান বিরোধী আইন মানিনা। অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে।
বিলুপ্ত না করা হলে এই আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ বাড়বেই। তাই বাতিল করার বিকল্প নাই।
লেখক :নির্বাহী পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা : এফ এফ এল বিডি ফাউন্ডেশন।
নির্বাহী পরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা :এফ এফ এল ইয়ুথ ফাউন্ডেশন।
নির্বাহী পরিচালক :ফ্রেন্ডস ফর লাইফ সমবায় সমিতি লি :
সম্পাদক ও প্রকাশক : বরিশাল খবর।
প্রকাশক :এফ এফ এল নিউজ।
প্রধান বার্তা সম্পাদক :দৈনিক শাহনামা।
প্রতিষ্ঠাতা :ফ্রেন্ডস ফর লাইফ।
সভাপতি : বরিশাল অনলাইন সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বরিশাল অনলাইন প্রেসক্লাব।
মহাসচিব :সচেতন নাগরিক আন্দোলন।