ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল এখন সময়ের দাবি
প্রকাশ: ৩০ মার্চ, ২০২৩, ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
মামুনুর রশীদ নোমানী :
ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক সংবিধান বিরোধী ও মত প্রকাশে বাধাঁ নামক আইনটি বাতিলের দাবী জানাচ্ছি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি একটি বিতর্কিত আইন। ভিন্নমত দমনের আইন। আইনটি নিয়ে যখন জাতিসংঘ থেকে শুরু করে দেশ ও বিদেশের সরকার ও সংস্থাগুলোর মধ্য আলোচনা হচ্ছিল তখন এ আইনে নয় মাসের অন্তঃস্বত্তা চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে আটক অতঃপর জামিন বিষয়ে সর্ব মহলে এ আইনের ব্যবহার নিয়ে আবার সরব হয়ে উঠেছিল দেশ ও বিদেশের সচেতন মহল।
এদিকে প্রথম আলোর সাভার সংবাদদাতা শামসুজ্জামানকে ২৯ মার্চ বুধবার ভোররাত চারটার দিকে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকার বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় সি আইডি পরিচয়ে।
গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করে নেয় প্রথম আলো। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর; বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।
ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক ছিলেন শামসুজ্জামান। এই ঘটনার জের ধরেই তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন যুবলীগ নেতা সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামের এক ব্যক্তি।
এদিকে যুগান্তরের সাংবাদিক মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। ২৯ মার্চ বুধবার সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামে মামলাটি করেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক উপ–অর্থবিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর। মাহবুব আলম যুগান্তরের ঢাকা অফিসের বিশেষ প্রতিনিধি।
এছাড়া খুলনায় দেশ টিভির বিভাগীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ অসিম এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে৷ স্থানীয় একটি বিউটি পার্লারের মালিক তানিয়া ইসলাম ওরফে তানিয়া শিকদার গত ২১ মার্চ সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত ২৯ মার্চ বুধবার অভিযোগ আমলে নিয়ে খুলনা সদর থানাকে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সাংবাদিক অসিম সম্প্রতি ওই বিউটি পার্লারের মালিক তানিয়াকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন যা দেশ টিভিতে প্রচার করা হয়। তাতে ওই বিউটি পার্লারের কার্যক্রমের আড়ালে অনৈতিক কর্মকান্ডের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
সর্বশেষ ২৯ মার্চ বুধবার দিনগত গভীর রাতে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও শামসুজ্জামানকে আসামী করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার রমনা থানায় করা এই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদকের সাথে নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভারে কর্মরত) শামসুজ্জামানকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামিদের মধ্যে ‘সহযোগী ক্যামেরাম্যান’সহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
এই মামলার বাদী আইনজীবী আবদুল মালেক (মশিউর মালেক)।
দেশজুড়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছে । সাংবাদিকদের মাঝে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই হতে পারে এমন উদ্বেগ দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছে সাংবাদিক নেতারা।
বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক, ও বাকস্বাধীনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং ৩৯ (২-ক) এ প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়িত করতে পারে। তথ্য জানা যেহেতু অধিকার- এই অধিকারের ইতিবাচক ব্যবহার দরকার। কারণ তথ্য জ্ঞান সৃষ্টি করে। জ্ঞান মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কট দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অথচ আজকাল অনলাইন মাধ্যমে সত্য বলা অনেকটাই কঠিন। চোরকে চোর বলা যাবেনা।
একজন চোর চুরি করতে গিয়ে আটক হলো। ঐ চোরের বিরুদ্ধে কেউ দু কলম অনলাইন মাধ্যমে লিখলে মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। কারন চোরের চুরি সম্পর্কে লিখলে চোরের ইজ্জত যায়।
কেন কি কারনে এই কালো আইনটি করা হয়েছে তা সকলেরই জানা। যখন যার ওপর এই আইনটির প্রয়োগ হয় তখনই তারা সোচ্চার হয়। আমি মনে করি এই আইনটি সকলের জন্য বিষফোঁড়া।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং তাঁকে আটকের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ আজ বুধবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানান। তাঁরা অবিলম্বে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ …..
সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ইতিমধ্যেই সাংবাদিকতাসহ বাক্স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের কাছ থেকেও আইনটির পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিয়োজন ও সংযোজনের বিষয়ে নানা ধরনের পরামর্শ, সুপারিশ ও উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
আইনটি তৈরির সময় থেকেই সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিকেরা এ আইনের বিষয়ে উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। আইনমন্ত্রী এ আইনের বিভিন্ন ধরনের অপব্যবহার এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও এ আইনের মাধ্যমে সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানের দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ করার দাবি সিপিজের……..
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ।ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক সংবাদে সিপিজে
শামসুজ্জামানের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক এই সংগঠনটি বলেছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তাঁর কাজ সংক্রান্ত তদন্ত বন্ধ করতে হবে এবং প্রথম আলো পত্রিকার কর্মীরা যেন হস্তক্ষেপ বা প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয় ছাড়াই খবর তৈরি করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। বুধবার সিপিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
সিপিজের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কার্লোস মার্টিনেজ দে লা সেরনা বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো, যাতে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে শামসকে মুক্তি দিতে হবে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন, তাঁদের কণ্ঠরোধে এই আইন বার বার ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিপিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ দায়েরের পর অবিলম্বে কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হবে না। কিন্তু বারবার বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে কারাদণ্ড এবং সাংবাদিকদেরকে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল এখন সময়ের দাবি…………
ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার কথা বলা হলেও এতে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থেও আইনটির চরম অপব্যবহার হচ্ছে।
সেন্টার ফর গভর্নরস স্টাডিজের (সিজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ আইনে ১ হাজার ১০৯টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি হয়েছেন ২ হাজার ৮৮৯ জন। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। নিষ্পত্তি হওয়া ২ শতাংশ মামলায় কেউ দণ্ডিত, কেউ খালাস পেয়েছেন। কিন্তু যেসব মামলার তদন্ত ঝুলে আছে, সেসব মামলার অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরে হয়রানি ও নির্যাতন ভোগ করছেন।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের আগে দায়ের করা ৭২৫টি মামলা এখনো তদন্তাধীন। আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা এবং প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন বাড়ানোর বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। অভিযুক্তদের কেউ কেউ জামিনে মুক্তি পেলেও বাকিদের কারাগারেই থাকতে হয়। এই আইনের বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। এ আইনে আটক লেখক মোশতাক আহমেদ অসুস্থ অবস্থায় কারাগারেই মারা যান।
দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন মহল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হলেও সরকার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। এই আইনের অপব্যবহার ও বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন। তিনি আইনের অপব্যবহার বন্ধের কথা বললেও বাস্তবে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেনি।
সাংবাদিকেরা শুরু থেকে আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এই আইনে যেসব ধারা আছে, তাতে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা কেবল দুরূহ নয়, অসম্ভব। এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ছাড়া আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করায় কোনো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয় বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক আইনটি সংশোধনীর তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার ও মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর থেকে একটি চিঠি (টেকনিক্যাল নোট) দেওয়া হয়েছে। এটি সরকার পর্যালোচনা করে দেখছে।
আমরা মনে করি, আইনটি সংশোধন বা পরিমার্জন সমস্যার সমাধান দেবে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার হবে না বলে মন্ত্রীদের আশ্বাসও কোনো কাজে লাগবে না। যদি সরকার গণতান্ত্রিক শাসন, ভিন্নমত তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।