মাঠ পর্যায়ের উন্নয়ন এখন চোখে পড়ছে বহির্বিশে্বও। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন নিচের ধাপ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে। সাধারণের চাহিদার ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) উন্নয়নের রূপরেখা। যা এতকাল বাস্তবায়ন করছে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় লোকাল গবর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি)।
প্রকল্পের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কর্মসূচীর সফলতার পর এলজিএসপি লুপ্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। বর্তমানে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এলজিএসপির রূপরেখায় দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা তহবিল কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এলজিএসপির সর্বশেষ তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম চলতি বছর জুন মাসে শেষ হয়েছে। তবে কিছু অর্থ থেকে যাওয়ায় বাড়তি কার্যক্রম চলতি বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। পাশাপাশি ২০২০-২১ অর্থবছরে শুরু হওয়া সরকারের ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা তহবিল কার্যক্রম চলমান থাকবে। দেশের ৪ হাজার ৫শ’ ৭১টি ইউনিয়নের সঙ্গে ১৬টি পৌরসভা যোগ হয়েছে এই কার্যক্রমে।
এলজিএসপির সর্বশেষ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ৫ হাজার ৭শ’ ৪৪ দশমিক ২০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। গ্রামীণ উন্নয়নের এই কার্যক্রম দেশকে দ্রæত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে এগিয়ে নিচ্ছে।
বগুড়া জেলা স্থানীয় সরকার কার্যক্রমের ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ) মোঃ মনোয়ার হোসেন জানান, এলজিএসপির আদলেই ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা তহবিল কার্যক্রম সাজানো হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে এলজিএসপির কার্যক্রম শুরু হয়ে ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়ে যায়। এই সময়ে (গত ১৬ বছরে) এলজিএসপি যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে তার সকল কম্পোনেন্টেই সরকারী অর্থে ইউনিয়নগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান। গত প্রায় দেড় যুগে প্রতিটি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন মানবসম্পদের যে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে তা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দেশের যে কোন গ্রামে পাকা সড়কপথে পৌঁছা যায়। গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সেখানে আর অতীতের কুঁড়েঘর নেই। কৃষিতে যন্ত্র সভ্যতা চালু হওয়ায় হালের গরু ও গৃহপালিত গরু ছাগলের গোয়ালঘর নেই। গ্রামেই এখন ডেইরি ও পোলট্রি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এসব কার্যক্রমে উন্নয়নের সমতায় মাঠ পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারী পুরুষের সমউন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন অনেকদূর এগিয়েছে।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্রতিটি গ্রামের যোগাযোগে উন্নত সড়ক নির্মিত হয়েছে। গ্রামে শহরের সকল সুবিধাই মেলে। পাকা সড়কে যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। কৃষক কাছে ও দূরের হাসপাতালে পণ্য বিপণন করতে পারে। এই ইউপির চেয়ারম্যান মজিবর রহমান আলতাফ জানিয়েছেন এলজিএসপি চলাকালে উন্নয়নে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। বর্তমানে ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছে। সকল উন্নয়নে সরকার এগিয়ে এসেছে।
এই বিষয়ে নুনগোলা ইউপি চেয়ারম্যান বদরুল আলম জানান, প্রতিটি ইউনিয়নের আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে এখন বরাদ্দ মেলে। প্রতিটি স্কিম গ্রহণ করা হয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ওয়ার্ড সভায় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। নারী ও পুরুষের প্রতিনিধি সমানভাবে থাকতে হয়। গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠানো হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে। তারপর উপজেলা পরিষদের সভায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকল্প পাস করা হয়। শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফাহিম জাহান বলেন, প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়নে নারীর সরাসরি ভ‚মিকা থাকে। প্রকল্পের ওয়ার্ডভিত্তিক সকল বৈঠকে নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। কর্মসূচীর কমিটিতে নারীর মতামত না থাকলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। এভাবে নারীর ক্ষমতায়নে বড় ভ‚মিকা রেখে এসডিজির ৫ম অধ্যায় পূরণে সহযোগী হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি উন্নয়ন মনিটরিং ও অডিট করা হয় নিবিড়ভাবে। এ জন্য রয়েছে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট। যার মাঠ পর্যায়ে আছেন প্রতিটি জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক। তার সঙ্গে আছেন জেলা ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ)। বগুড়ার জেলা ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ) মনোয়ার হোসেন জানান, বগুড়া জেলার সাফল্য ৯৮ শতাংশ। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলার ১০৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) সরকারী অর্থ বরাদ্দ হয়েছে ১০ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৮শ’ ৭৫ টাকা। এই অর্থে ৭৬৭টি স্কিম বাস্তবায়িত হবে। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তাঘাট, বক্স কালভার্ট উন্নয়নের সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম রয়েছে। তিনি জানান, ইউপির নানা কর্মসূচীর রাজস্ব সময়মতো জমা হয়েছে।
বগুড়ায় ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের কর আদায়ে সেলফ এ্যাসেসমেন্ট ফরম তৈরি হয় বছর কয়েক আগে। সাধারণের অংশগ্রহণের কর আদায়ের এই পন্থায় জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। এই উন্নয়নের নির্দেশিকায় বলা আছে যে ইউনিয়নে অডিট আপত্তি থাকবে সেই ইউনিয়নে বাৎসরিক বরাদ্দের ২৫ শতাংশ দেয়া হবে। আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাকি ৭৫ শতাংশ দেয়া হবে। সেভাবেই প্রতিটি ইউনিয়নে উন্নয়ন কাজে জবাবদিহিতা এসেছে। এ ছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নের ভাল কর্মকাণ্ডেরর ওপর ৪০ নম্বর বরাদ্দ করা আছে। যে ইউনিয়ন পারফর্মেন্সে ৪০ নম্বর পাবে তাদের উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হবে। বগুড়ার ১শ’ ৮টি ইউপির মধ্যে ৯৫টি ইউপির পারফমেন্স খুব ভাল। বাকিগুলো ভাল করছে।
বরাদ্দের অর্থ প্রতিটি ইউনিয়নের ব্যাংকের হিসেবে যোগ হয়। প্রতিটি ইউনিয়নে বরাদ্দ মেলে জনসংখ্যা ও আয়তনভেদে। যে ইউনিয়নে বেশি উন্নয়ন হয় সেই ইউনিয়নে বাড়তি উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। যে ইউনয়নে উন্নয়ন কম হয় সেখানে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা করতে হয়। উন্নয়ন কেন কম হলো তার কৈফিয়ত দিতে হয়। সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে বগুড়ার ইউপিগুলোতে অন্তত ৫ হাজার স্কিম বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথমে দেয়া হয় মৌলিক থোক বরাদ্দ (বিবিজি)। এই অর্থে সফল উন্নয়ন দেখাতে পারলে পরবর্তী সময়ে আরেকটি বরাদ্দ মেলে যা দক্ষতাভিত্তিক বরাদ্দ (পিবিজি)। আশা করা হয়েছে পরবর্তী সময়ে পিবিজির বরাদ্দেও বগুড়া এগিয়ে থাকবে।
একটা সময় যে গ্রামের প্রসূতি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো থাকায় হাসপাতালে পৌঁছতে পারত না তারা এখন সময়মতো ম্যাটারনিটি সেন্টারে পৌঁছে। সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়। মা ও শিশু নিরাপদে থাকে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের হার বেড়েছে। কোন গ্রামে পল্লী বিদ্যুত না গেলে সোলার প্যানেলে বিদ্যুতায়িত হয় প্রতিটি ঘর। গ্রামের কোথায় কি করতে হবে তার চাহিদার নিরূপণ করে ওয়ার্ডের লোকজন। তারপর ইউপিকে জানায়। ইউপি ওয়ার্ডের ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় ও জবাবদিহি করে। পরিষদ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোটখাটো অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে। কোন স্কিম বাস্তবায়িত করার আগে পুরুষ ও নারীর সমন্বয়ে দেখভাল (সুপার ভাইজার) কমিটি গঠিত হয়। সকল কাজেই থাকে জবাবদিহিতা। এভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
এই কর্মসূচীর বৈশিষ্ট্য হলো : দেখভাল ও গ্রামের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিও থাকেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সর্বনিম্ন ধাপ ইউনিয়ন পরিষদকে আগে যেভাবে মূল্যায়ন করা হতো এখন তা পাল্টেছে। এখন মূল্যায়ন হয় উন্নয়নের অগ্রগতি দেখে। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়নের উন্নয়ন কার্যক্রম উপজেলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে।