একসময় মামার জমিদারি বলে একটি কথা প্রচলিত ছিল। এর অন্তর্গত দ্যোতনা হচ্ছে, মামার জমিদারিতে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে কূটনীতিকদের কথাবার্তা-আচরণ-তৎপরতা দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তারা কি মামার জমিদারিতে আছেন? বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নানা ধরনের মন্তব্য করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। ঢাকায় তাদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায়ই আলোচনার কেন্দ্রে স্থান পায়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে কখনোই বিদেশিরা এ সুযোগ পান না। প্রধান কারণ, সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যা বাংলাদেশে হয়নি। এটি দুঃখজনক বাস্তবতা এবং ইতিহাস বলে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিকরা এখনো ধাতস্থ করতে পারেননি, অথবা করতে চাচ্ছেন না। ফলে বিরোধী দল এখনো রাজপথে সরকারকে পরাজিত করে বিজয়ী হওয়ার হুঙ্কার দেয়। ক্ষমতাসীনরা রাজপথেই বিরোধী দলকে প্রতিরোধ করার পাল্টা হুঙ্কার দেয়। রাজনীতিতে এ বালখিল্য মানসিকতার সুযোগ নেয় বিদেশিরা।
বাংলাদেশের রাজনীতিসহ নানান বিষয় নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নানান মন্তব্য সীমা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। এ ক্ষেত্রে বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়ে দিয়েছেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির প্রসঙ্গটি টেনে আনেন। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির ঘোলাটে পরিস্থিতিতে কূটনীতিকরা অন্যরকম তৎপরতা শুরু করেছেন। তবে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, বাংলাদেশ কোনোরকম রাজনৈতিক সংকট মুখোমুখি হলেই যাত্রা গানের বিবেক চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বিদেশি কূটনীতিকরা। তবে এ ধারা সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নয়, বহু পুরোনো। বলা চলে প্রাচীন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট রাজনীতির রক্তাক্ত পটপরিবর্তন, পরবর্তীকালে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেনারেল এরশাদের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে এবং কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে বিদেশিদের তৎপরতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো দল বা দলীয় নেতাকেও বিদেশি রাষ্ট্র, যেমন চীনপন্থি কিংবা রাশিয়াপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোনো কোনো নেতা আবার আমেরিকার সোল এজেন্ট হিসেবে খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধের পর বিরোধী দল হিসেবে জাসদ গঠন, ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ এবং এর ধারাবাহিকতায় যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবকটির সঙ্গে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের ভূমিকা সম্পর্কে নানা তথ্য উঠে আসছে।
মোট কথা, রাজনৈতিক ইস্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের জড়িয়ে পড়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে সাধারণভাবে বলা হয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলো হচ্ছে উছিলা। রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে অদক্ষতা কিংবা অনাগ্রহ এবং দেশে নির্বাচন নিয়ে সংকটের কারণেই বিদেশি কূটনীতিকরা কথা বলার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে বিদেশি কূটনীতিকরা যখন ইন্টারফেয়ার করেন তখন ক্ষমতাসীনরা উষ্মা প্রকাশ করেন। আর যারা বিরোধী দলে থাকে তারা হয় পুলকিত। এ ক্ষত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একই সূত্রে গাথা। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কূটনীতিকদের বক্তব্য যার পক্ষে যায় সে সমর্থন করে। এ ধারা লাগাতরভাবে চলে আসছে। যার নগ্ন সূচনা নব্বইয়ের দশক থেকে। একানব্বইয়ে দেশ গণতন্ত্রে ফিরলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে কূটনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে যারা আসেন তারা শেষ পর্যন্ত আর ঘোষিত দায়িত্বের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন না। দেশের রাজনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রেই তারা সক্রিয় হয়ে পড়েন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইস্যুতে। আর বরাবরই বিরোধী দলগুলোকে দেখা যায় নানা ঘটনায় তাদের দ্বারস্থ হতে। এসব দলই আবার ক্ষমতায় গেলে কূটনীতিকদের সবসময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার নসিহত করেন। অবস্থানভেদে একই দল দুই ধরনের বয়ান দেয়।
জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তা টেকসই হয়নি। শক্তিশালী হয়নি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বাংলাদেশ ও রাজনৈতিক সংকট সমর্থক হয়ে গেছে। এ সুযোগে বিদেশিদের প্রভাব বিস্তার করার উদার জমিন সৃষ্টি হয়। আরও পরিষ্কারভাবে বলা চলে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই এ সুযোগ তৈরি করে দেয়। আবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব দেশ বেশি সহায়তা দেয় তারা যে কোনো ইস্যুতে কথা বলার সুযোগ নেয়। এদিকে ক্ষমতাসীন দল অনেক সময় কোনো একটি দেশের সঙ্গে বিশেষ সখ্যের দিক তুলে ধরার চেষ্টা করে। যেমন এখনকার অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা ‘লুক ইস্ট পলিসি’ নিয়েছিল। সেখানে চীনের ওপর তাদের নির্ভরতা বেশি প্রকাশ পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আবার বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের পর থেকে একচেটিয়াভাবে ভারতের সমর্থন পাচ্ছে বলে প্রচলিত আছে। আরও নাকি সমর্থন চায়। এ ব্যাপারে তো হাটে হাঁড়ি ভাঙার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন আমাদের গুণধর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বিপত্তির মূল কারণ এখানেই নিহিত বলে মনে করা হয়। ক্যান্সারের টিউমারের মতো। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়া গেলে হয়তো বিদেশিদের নাক গলানোর জমিন এতটা বিস্তৃত হতো না। এর দৃষ্টান্তও আছে। স্মরণ করা যেতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তেমন বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।
১৯৯০ সালের আগে দীর্ঘদিন দেশে সামরিক শাসন ছিল এবং সে সময়কার নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর। কয়েকটি নির্বাচন প্রধান দলগুলো বর্জন করেছে। এর পর জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হয়। যার ফলে রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছলে শুরু হয় বিদেশিদের নাক গলানোর মোক্ষম সুযোগ। আর তাতে সায় ছিল ক্ষমতার বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর। শুধু তাই নয়, ২০০৬-এর শেষদিকে এবং ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা দেশের কিছু কূটনীতিক ছিলেন বেশ তৎপর। উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিসের গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, ঢাকায় পশ্চিমা কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নিজেদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করতেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কফি গ্রুপ’। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি। এই গ্রুপে জাপানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ২০০৭ সালের ৪ জুন দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতির অবনতি হলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে।’ বাস্তবে হয়েছেও তাই এবং এর খেসরাত কিন্তু কম দিতে হয়নি আমাদের রাজনীতিকদের। এমনকি ‘টু মাইনাস ফর্মুলা’ বাস্তবায়িত হতে হতে কোনোরকম বেঁচে গেছেন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। এমনটাই বলে থাকেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনীতির আকাশে আবার সেই পুরোনো মেঘ দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সবাই অনুভব করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি কূটনীতিকরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছেন। যেটি ঘটা করে জানান দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে ১৫ দেশের দূতাবাসের বিবৃতির মধ্য দিয়ে, ৬ ডিসেম্বর। আর এটির শানেনজুল জানান দিয়েছেন ১৫ দেশের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় রাষ্ট্রদূত গিয়ে প্রায় ২৫ মিনিট অবস্থান করেছেন। এই নেতা গুম হয়েছেন এক দশক আগে, ২০১৩ সালে। কারোরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের উসকানির বীজ বপন। আবার ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে কতিপয় ব্যক্তি ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে কান্না শুরু করে দেয়। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ দমনের ঘটনায় সহস্রাধিক সদস্য গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’। বোঝাই যাচ্ছে এর পেছনেও কারসাজি রয়েছে। সবার কাছেই অত্যন্ত পরিষ্কার, বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যাওয়ার নেপথ্য কারণ হচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে জট পাকানো। বিদেশি এ অপকৌশল বিবেচনায় না নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার নামে ফাঁদে পা দেওয়া বিষয়টি কার মগজ থেকে উৎসারিত?
অন্যরকম বাস্তবতাও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানোর এই যে ধারা তার ক্ষেত্র কিন্তু রাজনীতিকরাই তৈরি করেন। রাজনীতিতে একপক্ষ অন্যপক্ষকে বিনাশ করতে চায়। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের একটি বড় উদাহরণ। আবার এই বিনাশ অপচেষ্টার শিকার আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ২০১৪ ও ’১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে যে কৌশল অবলম্বন করেছে তাও প্রকারান্তরে প্রতিপক্ষকে বিনাশ প্রয়াসের নামান্তর বলে অনেকে মনে করে থাকেন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীপক্ষ যেভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে সেটাকে অনেকের বিবেচনায়, দুজনের জন্য একটি কবর খোঁড়ার মতো বিষয়। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি শক্তিগুলো অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে; যা আখেরে বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিদেশি শক্তিগুলো এখন রাজার ভূমিকায়, আমরা নলখাগড়া। ফলে দেশ হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি তা বলা কঠিন।