মঙ্গলবার ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ই-পেপার   মঙ্গলবার ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ



কাঠমিস্ত্রি থেকে চারণ কবি
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ

কাঠমিস্ত্রি থেকে চারণ কবি

লেখা:
বশির আহমেদ

কাঠমিস্ত্রি থেকে কবি! কী অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। জীবন তার খুব সহজ-সরল। বেশভূষাতেও নেই কোনো চাকচিক্য। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি তার সারা জীবনের অহংকার। জীবনে কখনো পায়ে ওঠেনি দামি স্যান্ডেলও। গ্রামের সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই মানুষটির তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই, পাস দিয়েছেন মাত্র তৃতীয় শ্রেণি। তারপরও তাঁকে নিয়ে হইচই। তিনি চারণ কবি মো. শাহাজামাল মিঞা। হাজারো কষ্টের মাঝে সাহিত্যচর্চা করেন। লেখেন; কবিতা, ছড়া, গল্প, ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি, ইসলামি ও দেশগান। দারিদ্র্যকে আঁকড়ে ধরে নিয়মিত করে যাচ্ছেন কাব্যচর্চা। তাঁর লেখায় ফুটে উঠছে গ্রামীণ জীবন, সমাজসভ্যতা ও দেশপ্রেম। আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ তাঁকে কবি শাহাজামাল নামেই চেনেন। জীবনের এক অমোঘ ও অলৌকিক নিয়মেই কবি নিমগ্ন হন লেখায়। সেই মৃত্যুঞ্জয়ী নেশাই তাঁকে তৈরি করে দেয় কবি হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘অনেককাল আগে থেকেই একজন লেখকের প্রস্তুতি চলে, লেখক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’ শাহাজামাল প্রস্তুতির কাজটা অবশ্য সচেতনভাবে করেননি। কীভাবে যে প্রক্রিয়াটা ঘটেছে, এ সম্পর্কে তাঁর ধারণা পর্যন্ত নেই। তবে যাপিত জীবনে কষ্ট-ক্লিষ্টের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে থাকা বেদনাগুলোই সাজিয়ে তুলেছে তাঁর কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।

কবি ও কাঠমিস্ত্রি—দুটি গল্পই একেবারে ভিন্ন রকমভাবে অনিবার্য হয়ে হাজির হয় তাঁর জীবনে। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের রামেশর শর্মা গ্রামে স্বাধীনতাপূর্ব ১৯৬৯ সালের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের মাসে অর্থাৎ ১৯ মে জন্ম নেন তিনি। সংসারে স্ত্রী মোর্শেদা বেগম আর চার সন্তান। বড় মেয়ে জামিলা কোরআনে হাফেজ, দ্বিতীয় ছেলে মনিরুজ্জামাল দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার কাজে সহায়তা করেন, তৃতীয় ছেলে ওয়াহিদুজ্জামাল পড়েন হেফজখানায় আর ৪ বছরের হোসনে আরা। ৫ শতাংশ জায়গায় একটি টিনের ঘরে দুটি কক্ষই কবির বসত। দারিদ্র্য তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী। কবি মনে করেন; দারিদ্র্যই তাঁর অহংকার।

এই চারণ কবি পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও ঘরে খাট-পালং তো দূরের কথা, শোয়ার মতো চৌকিও নেই। তাই মাটিতেই খড় বিছিয়ে রাত্রযাপন করেন বছরের পর বছর। নেই শীত নিবারণের পর্যাপ্ত কাপড়। সেটা বিছানা কিংবা গায়ে দেওয়ার। ঘরের ভেতর থেকে দেখা যায় আকাশ। বর্ষা-বাদলে ভেজে বিছানা আর শীতের কালে ঠান্ডায় কাহিল হয় তাঁদের জীবন।
কবি হয়ে ওঠার গল্প

চারণ কবি মো. শাহাজামাল মিঞা লেখালেখি করেন ৩৫ বছর ধরে। দারিদ্র্য তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে হার মানাতে পারেনি। সারা দিন কর্মব্যস্ততায় থেকেও নিস্তব্ধ রজনীতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন ঘরে কুপি জ্বালিয়ে তাঁর মনের ভেতরে দিনভর উঁকি দেওয়া সাহিত্যের ফুলঝুরি প্রসব করেন কাগজে। এভাবেই বহু রজনী কেটে যায় ব্যাকুল হৃদয়ের কবিতা, গল্প আর গান লিখতে লিখতে।

কবিভাবনা: ‘এমনি এমনি দুনিয়াতে আসলাম আর গেলাম—এটা কেমন হলো?’ তাই তাঁর ইচ্ছা দেশের জন্য একটা কিছু করা। মানুষকে কিছু দেওয়া। মাঝে মাঝে আবার থেমেও যান। এভাবে লিখে ফেলেন শতাধিক কবিতা, ছড়া, গান-গল্প। লেখাগুলো ঠিকঠাক হলো কি না, তা যাচাই করার জন্য যান শিক্ষিতজনদের কাছে। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে আবার লিখতে থাকেন। কিন্তু প্রকাশ করবেন কোথায়? কে দেবে ঠাঁই এই অজপাড়াগাঁয়ের অখ্যাত কবিকে। আদৌ কী স্বীকৃতি দেবে ভদ্রশ্রেণি? হেঁটে কবিতা প্রকাশের জন্য ঘুরেছেন বেশ পথ। তাঁর খেদ ছিল এ রকম; ‘যদি প্রকাশ করার সুযোগ না থাকে, তাহলে বিধাতা এগুলো আমাকে কেন দিল?’
কাঠমিস্ত্রি থেকে চারণ কবি

তিন বছর আগের কথা। এক গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় কবি শাহাজামালের, কী একটা স্বপ্ন দেখে! বিছানায় উঠে বসে লিখে ফেলেন; স্বপ্নে দেখা সেই কথাটি সত্য হবে কবে ত্রিশ বছর আগে যেটা শুনেছি মায়ের জবে মায়ের কথা যায় না বৃথা, শুনেছি অনেক আগে তাহলে কি সত্য হবে, সত্য হবে কবে?

এই কবিতা লেখার পর কবি ভাবলেন, ‘এখন আমার কবিতা প্রকাশ হবে, অবশ্যই হবে এতে কোনো ভুল নেই।‘ পরের দিনেই দেবদূত হয়ে সাক্ষাৎ দেন উলিপুরের আরেক কবি ও মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ। তিনিই দেখান আলোর পথ। কবি মো. শাহাজামালকে ডেকে নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা ও রংপুর বিভাগ লেখক পরিষদের সদস্য করে নেন। এর পরেই বিকশিত হতে থাকে কবির কবিতা। ৬০টি কবিতা নিয়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলায়’ পাতা প্রকাশনী নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করে ‘আলোর পথে’ নামে কবিতাগ্রন্থ। পরে অবশ্য কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন আয়োজিত ‘বইমেলা ২০১৯’-এ এই কাব্যগ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করে কবিকে দেওয়া হয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা।

এখন পর্যন্ত ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি, দেশ ও ইসলামি গান লিখেছেন ৮৫টির মতো। কবিতা, ছড়া-গল্প লিখেছেন ছয় শতাধিক। ‘আলোর পথে’ প্রকাশের পর গ্রামে হাঁকডাক শুরু হয় কবি নামে। মুছে যেতে শুরু করে তাঁর নামের আগে ব্যবহার হওয়া মিস্ত্রি শব্দটি।

চারণ কবি মো. শাহাজামাল মিঞার কবিতা, ছড়া ও গল্পগুলো এখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে স্থানীয় খবরের কাগজসহ সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে। এ ছাড়া তাঁর ভাওয়াইয়া ও পল্লিগীতিগুলো বেতারের তালিকাভুক্ত স্থানীয় বিশিষ্ট শিল্পীরা সংগ্রহ করে পরিবেশন করছেন বিভিন্ন মঞ্চে।
হঠাৎ কাঠমিস্ত্রি

চারণ কবি মো. শাহাজামাল মিঞার কাঠমিস্ত্রি হওয়ার গল্পটাও কিন্তু একেবারে ভিন্ন রকম। ১৯৯৩ সালে বিয়ের পরে সংসার চালাতে গিয়ে দিশা হারিয়ে ফেলেন! কী করবেন ভেবে পান না। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসে কাঠমিস্ত্রির কাজ করবেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, কবির এ কাজের আগে কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছিল না। এই ভাবনা থেকেই কিনে আনেন কাঠমিস্ত্রি কাজে ব্যবহৃত হাতুড়-বাটালসহ অন্যান্য যন্ত্র। কিন্তু কে দেবে কাজ? অভিজ্ঞতা তো নেই তাঁর। সে কারণে তিনি গ্রামে গিয়ে নিজ উদ্যোগে গাছ কিনে ‘স’ মিলে কেটে বাড়িতে এনে নিজ বুদ্ধিতে তৈরি করেন চেয়ার, টেবিল ও আলনা। সেগুলো রং করে বাজারে নিয়ে যান বিক্রি করতে। প্রথম দিনেই সব আসবাব বিক্রি হলো অল্প সময়েই। কারণটা হলো অন্য দোকানিদের তুলনায় তাঁর পণ্যের সৌন্দর্য ছিল ভিন্ন রকম।

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এখন আর বাজারে আসবাবপত্র বিক্রি করেন না তিনি। গ্রামের মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের কাঠের শৌখিন আসবাব তৈরি করেন নৈপ্যুণ্যের সঙ্গে। সেই উপার্জনেই এখন তাঁর সংসার নির্বাহের মাধ্যম।

চারণ কবি মো. শাহাজামাল মিঞা জীবিকার তাগিদে শিক্ষাজীবন পেরোতে পারেননি প্রাথমিকের গণ্ডি। তিনি মূলত জীবনের পাঠ থেকেই আহরণ করেছেন প্রয়োজনীয় শিক্ষা। স্বপ্নচারী মানুষটি প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখেন এই দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে এবং বেড়ে ওঠা সমকালের প্রজন্ম নিয়ে। ব্যস্ত জীবনে জীবিকা ও সংসারধর্মের দায় মিটিয়েও তিনি আগলে রাখার চেষ্টা করেন ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোকে। এ স্বপ্নগুলোরই আশ্রয় তাঁর প্রতিটি লেখা।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

প্রধান উপদেষ্টা : প্রফেসর শাহ্ সাজেদা ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সৈয়দ এহছান আলী রনি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।

যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল।

ইমেইল: [email protected]

মোবাইল: 01713799669/01711358963

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।
© বরিশাল খবর সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

  নলছিটির মগড় ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চান মোঃ সাইফুজ্জামান সুমন তালুকদার   প্রাণ ফিরছে বরিশাল নগরীর ৭ খালে   বেতারের সঙ্গীত শিল্পী (পল্লীগীতি) হিসেবে মনোনীত হলেন অ্যাড: জুয়েল   বরিশালের মাহমুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী প্রধান শিক্ষিকা স্ট্যান্ড-রিলিজ !   বরিশাল ল’ কলেজে দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ   অনিয়ম দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল বেতার : চলছে জোড়াতালি দিয়ে   বরিশাল ডাকঘরের ক্যাশিয়ার নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ   দেড় লাখ মামলা মাথায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীর   আলু শুন্য বরিশালের পাইকারী বাজার   বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর মার্কিন ভিসানীতি শুরু   মাদারীপুরের হিমাগারে ৩০ হাজার বস্তা, বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট   যুদ্ধ স্যাংশন সংঘাতের পথ এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান   Mamunur Rashid Nomani charged with violating Bangladesh’s Digital Security Act   ঝালকাঠিতে রোহিঙ্গা আটক এসেছিলো ভোটার হওয়ার জন্য   সাঈদুর রহমান রিমনকে নিয়ে দিলিপ কুচক্র মহলের ষড়যন্ত্রের জবাব!   বাবুগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের চার সদস্য আটক   নলছিটিতে ৫০তম গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ   অপরাধ ঘটাতে আগাম ‘রেকি‘ করে গেছেন তারা!   ঝালকাঠি কারাগার: কু-প্রস্তাবের দাম দশ লাখ টাকা! জেলার বহাল তবিয়তে   রাজাপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দুর্নীতির আখড়া