বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ, যাদের দশমিক শূন্য নয় শতাংশ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। আমাদের দেশে ৫৪টিরও অধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাস করে। এদের সরকারি দলিল, আইন, নীতিমালা, ঘোষণা ও দাপ্তরিক নথিতে আদিবাসী, উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করা হলেও এ নীতি প্রণয়নের সমসাময়িককালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পর, ‘উপজাতি’ বা ‘আদিবাসী’র পরিবর্তে ‘ক্ষুদ নৃ-গোষ্ঠী’ এখন অনেকটা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে স্থায়ী পরিভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
nagad-300-250
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের সমতলের ১৬ জেলায় এ বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এসব সম্প্রদায়ের সামাজিক সংগঠনগুলো আজও মূলস্রোতধারার প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। অন্যদিকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নানামুখী অস্থিরতা চলমান; দেশে দেশে জাতিগত ও সামাজিক-রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা; ব্যাপক অভিবাসন ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন শ্রেণি, জাতিসত্তা এবং বিশ্বাস ও মতবাদের মানুষ নানামুখী সমস্যায় পড়ছে। এতে উগ্র জাতীয়তা ও ধর্মীয় ভাবধারার উত্থান হচ্ছে এবং অন্যদিকে আমাদের সামাজিক উদ্যোগের পরিসরকে সংকুচিত করছে। মূলত এসব কারণেই আমাদের দেশে সংখ্যালঘু জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস ও মতবাদের মানুষের প্রতি মূলস্রোতধারার কিছু মানুষের সংবেদনশীলতা আজও কম। আর তাই তো টেকসই উন্নয়নকে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ করতে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)তে ‘কাউকে পিছিয়ে ফেলে নয়’-এই মূলমন্ত্র সংযুক্ত করা হয়েছে।
ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) মাধ্যমে The Asia Foundation’ সহায়তায় ‘Activation Communities and Citizen Groups for Transparent and Effective Services for Plain Land Ethnic People (ACCESS) প্রকল্পটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ঠাকুরগাঁও জেলার সদর, পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। স্থানীয় জনসমষ্টি এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে জবাবদিহিতামূলক কার্যকর সেবাদানকারী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস এবং সব ধরনের সেবাপ্রাপ্তিতে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কার্যকর অভিগম্যতা সুনিশ্চিত করার মূল লক্ষ্য নিয়ে বাস্তবায়নাধীন ACCESS প্রকল্পের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে শিখন ও অর্জনগুলো নিম্নরূপ-
ভূমি
ক. প্রকল্প শুরুর আগে কর্ম এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ভূমিবিষয়ক কোনো কমিটি ছিল না। পাশাপাশি ভূমি অফিসে কী ধরনের সেবা রয়েছে, সে সম্পর্কে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ধারণা ছিল খুব কম। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জমিজমার নথিপত্র যেমন-খতিয়ান, জেএল নম্বর, ডিভি, এসএ খতিয়ান, রেকর্ড, দলিল, মৌজা, ম্যাপ সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই কম। ভূমি কমিটি গঠন হওয়ার কারণে জমিজমাসংক্রান্ত সেবাপ্রাপ্তিতে তাদের অভিগম্যতা কিছুটা বেড়েছে।
খ. যদিও সরকারিভাবে ঠাকুরগাঁও সদরের দুটি মৌজায়, রানীশংকৈল’র দুটি মৌজায় এবং পীরগঞ্জের দুটি মৌজায় ডিজিটাল সার্ভে শুরুর প্রক্রিয়া চলছে; তথাপিও ওই এলাকায় অভিজ্ঞ জনবল ও সরঞ্জামাদির ঘাটতি রয়েছে।
গ. ভূমির ডিজিটাল সার্ভে সম্পর্কে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কিছুটা ধারণা তৈরি হয়েছে, তবে আরও কর্মশালার আয়োজন করলে তারা এ ডিজিটাল সার্ভে, খতিয়ান সম্পর্কে বিস্তর ধারণা লাভ করবে।
ঘ. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জমিজমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন-খতিয়ান, জেএল নম্বর, মৌজা, ম্যাপ, দাগ নং, এসএ খতিয়ান, বিএস খতিয়ান, স্কেস ম্যাপ, দলিল ও খাজনা-খারিজ না থাকায় তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও মূলস্রোতধারার লোকজনের মধ্যে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ করা হয়েছে।
ঙ. নিয়মিত ভূমি সভার কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা ভূমিবিষয়ক সেবাগুলো সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারলেও ভূমিসংক্রান্ত বিষয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে হয়রানি ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরকারি সেবা
ক. সরকারি অফিসের (ভূমি, সমাজসেবা, যুব, মহিলাবিষয়ক, কৃষি ও প্রাণী, ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য) কর্মকর্তাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য প্রদেয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। পাশাপাশি তাদের নিকট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রবেশাধিকার সীমিত।
খ. খাসজমি বরাদ্দ, সরকারি পুকুর, বন বিভাগের সুযোগ-সুবিধা এবং বরেন্দ্রর পানি ইত্যাদিতে তাদের অভিগম্যতা খুবই কম। তবে বর্তমানে প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা এসব সরকারি সুযোগ-সুবিধার দাবি করতে শুরু করেছে। সীমিত হলেও কেউ কেউ এসব সুবিধা পেয়েছেন।
গ. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন ইউনিয়ন ও উপজেলাভিত্তিক সেবাগুলো সম্পর্কে না জানার কারণে ও যথাযথ পরিবেশের অভাবে ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি, বয়স্কভাতা ও বিধবাভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের অভিগম্যতা সীমিত।
ঘ. জ্ঞান ও তথ্য আদান-প্রদানের ফলে প্রকল্পভুক্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সেবা প্রসঙ্গে জানতে পারছে। এতে সরকারি
সেবায় অভিগম্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঙ. সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কমিউনিটি সংগঠনগুলোর পরিপূর্ণ ধারণার অভাব এবং অভিগম্যতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সেবা
ক. স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠনগুলো যেমন-ক্লাব, সমিতি, ফোরাম, গ্রাম উন্নয়ন কমিটি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উন্মুক্ত বাজেট সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা কমিউনিটির উন্নয়নে ইউপির বাজেটে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
খ. উন্মুক্ত বাজেট আয়োজনের জন্য যদিও সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে, তথাপিও বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত বাজেটের আয়োজন করে না। তবে প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকাভুক্ত উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে উন্মুক্ত বাজেট আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ তৃণমূলের জনগোষ্ঠী এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা, সেবার ধরন ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে এবং নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারছে।
সামাজিক নিরীক্ষা
ক. প্রকল্পের সামাজিক নিরীক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন-স্ট্যান্ডিং কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেছে।
খ. কমিউনিটি মনিটরিং সম্পর্কে বিভিন্ন সিটিজেন গ্রুপ যেমন-শিক্ষক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ইমাম, পুরোহিত, মানঝিহারাম, জগমাঝি, পাস্টর এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না। প্রকল্পের কমিউনিটি মনিটরিং কার্যক্রমের মাধ্যমে সিটিজেন গ্রুপগুলো কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম নির্ধারণে ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে।
গ. প্রকল্পের সিটিজেন রিপোর্ট কার্ডসহ অনেক ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে যুব সম্প্রদায় ধারণা অর্জন করেছে।
যুব কার্যক্রম
ক. উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার অভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুবক-যুবতীরা কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। বর্তমানে প্রকল্পের যুব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কমিউনিটির যুবক/যুবতীরা নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে; যেমন-বেকারত্ব, মাদক, বাল্যবিবাহ, কমিউনিটিভিত্তিক দ্বন্দ্ব, স্বাস্থ্যসচেতনতা, অশিক্ষা, আধুনিক কৃষি ও প্রাণী পালন ইত্যাদি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুবক-যুবতীরা মাদকের কুফল সম্পর্কে জানলেও মাদকাসক্তির প্রবণতা কিছুটা বিদ্যমান।
খ. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুবক-যুবতীদের সরকারি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তি ও এর মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ততা অনুল্লেখযোগ্য।
গ. কমিউনিটিতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন-শিক্ষার অভাব, কমিউনিটিভিত্তিক দ্বন্দ্ব, ভূমিবিরোধ, স্বাস্থ্য সমস্যা, আধুনিক কৃষি জ্ঞানের অভাব, অপুষ্টি, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যবিষয়ে অসচেতনতা বিদ্যমান রয়েছে।
ঘ. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর।
ঙ. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সেবায় অভিগম্যতা খুব কম।
পরিবার
ক. পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের অংশগ্রহণ কম।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
ক. সমতল ভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যেমন-পুষনা উৎসব, সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস, বাহা দিবস, কারাম উৎসব, শিকার, লোকসংগীত ও স্বতন্ত্র পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবারও ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
অংশীজনের কাছে প্রত্যাশা
১. সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মূল সমস্যা ভূমি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠায় সরকারের সঙ্গে অধিপরামর্শ জোরদারকরণ একান্ত প্রয়োজন।
২. স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সরকারি সেবায় অভিগম্যতা প্রাপ্তিতে বিদ্যমান নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে জাতীয় উদ্যোগগুলোর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বৃহত্তর নাগরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা জরুরি।
৩. স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সমস্যা, সংকট, হয়রানি বন্ধ এবং সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে অভিগম্যতা সুনিশ্চিতকরণে সরকারি পর্যায়ে সহায়তা ও নির্দেশনার জন্য নিয়মিত অধিপরামর্শ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৪. সামগ্রিকভাবে সরকারের এবং এসডিজির মূল দর্শন ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’-কে কেন্দ্র করে সমতলের উপেক্ষিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ন্যায়সংগত অধিকার প্রাপ্তিতে সবার সম্মিলিত যুক্ততার মাধ্যমে বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তন করা জরুরি।
ড. মুহাম্মদ শহীদ উজ জামান : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেসন (ইএসডিও)