বিশ্ববাসীর বহু শতাব্দীর চিন্তা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ধসিয়ে দিয়েছে করোনা নামের ক্ষুদ্র ভাইরাসটি। অপ্রতিরোধ্য গতিতে অদৃশ্য এই অণুজীব বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। অচল হয়ে পড়ছে সভ্যতা, ধ্বংসের মুখে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রাণহানির পাশাপাশি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিশ্বকে নানাভাবে ওলটপালট করে দিচ্ছে। আঘাত হানছে বিশ্ব প্রকৃতিতেও। দুনিয়ার নানা বৈচিত্র্যের ঘটনায় না গিয়ে বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের কুকুরগুলোর কান্ড ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়।
করোনার ভয়ে দোকানপাট-হোটেলসহ সবকিছু বন্ধ থাকায় খাবার না পেয়ে রাজশাহী শহরের কিছু কুকুর সেদিন নগরের শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় ঢুকে চারটি হরিণ ছিঁড়ে খেয়েছে। ভোরে কাক ডাকার আগেই পাঁচটি ক্ষুধার্ত-ক্ষেপা কুকুর চিড়িয়াখানায় হরিণের খাঁচায় ঢুকে তিন হরিণ শাবককে ধরে ফেলে। এ সময় মা হরিণ এগিয়ে গেলে কুকুরগুলো তাকেও আক্রমণ করে। চারটি হরিণ মারার পরে কুকুরগুলো আর সেখান থেকে বের হওয়ার পথ পায়নি। কর্মচারীরা সকালে কুকুরগুলোকে বের করে দেন। পরে হরিণগুলোর ছেঁড়া দেহাবশেষ চত্বরের ভেতরেই মাটিতে পুঁতে ফেলেন।
এর আগে, কুকুরগুলোকে হাতের নাগালে পেলেও ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পায়নি কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়দের কাছে এটি কেবলই গালগল্পের বিষয় হলেও চিন্তাশীলদের কাছে ভিন্ন কিছু। বর্তমান-ভবিষ্যতে এমন আরো অস্বাভাবিকতার বার্তা। এ নিয়ে চিন্তাশীলরা বলছেন, করোনার প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হলো চলতি দুর্যোগের মাত্র প্রথম পাঠ। ধাপে ধাপে এর পরের অধ্যায়গুলোও হাজির হতে থাকবে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী এই শিক্ষা হয়েছে, মানবজাতির একাংশকে বিশুদ্ধ পানি ও ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত রেখে অন্যত্র সুস্বাস্থ্যের স্বর্গ বানানো যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বিশ্বের মুরব্বি দেশগুলোর নেতারা করোনাকালে বিশ্বকে মোটেই নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তাঁদের তরফ থেকে এমন একটি বাক্যও পাওয়া যায়নি, যা বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে। এটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের তাগিদও দিচ্ছে। অতীত মহামারীর ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্ত আছে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বহু রাজত্ব নুয়ে পড়েছিল। তবে সব মহামারীর শিক্ষা এক রকম নয়। এটাও অতীতেরই শিক্ষা। বিশ্বের বর্তমান প্রজন্ম এ রকম সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক দুর্যোগ আর দেখেনি।
করোনার ক্ষয়ক্ষতির শেষ কোথায়, কেউই বলতে পারছে না। প্রথম দিকে কারো মনে হয়নি চীন এত দ্রæত ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এটাও মনে হয়নি যে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বিপর্যয় এত ব্যাপক হবে। তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ওই সব অঞ্চল। অথচ সেখানেই অস্তিত্বের সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে। আপাতত যা দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সময়মতো নিজের অনেক নাগরিকের ‘ভাইরাস টেস্ট’ করাতে পারেনি, পাশাপাশি নিজেও বৈশ্বিক ‘গভর্ন্যান্স-টেস্টে’ এত দিনকার অবস্থান হারিয়েছে।
মহামারী কেবল রাজনীতিতে নয়, নাটকীয় পরিবর্তন নির্দেশ করে অর্থনীতিতেও। ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিজ্ঞতা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক নাগরিকের জন্য জীবনে এই প্রথম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ এবং জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা। বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। অর্থনৈতিক গোলকায়নের জন্য এ রকম অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে বিপর্যয়কর। বড় ধরনের মন্দার মুখে পড়েছে গোটা বিশ্ব। বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে কেবল পুঁজির স্বার্থ দেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য এবার কেবল নৈতিকভাবেই নয়, কার্যকারিতার দিক থেকেও চ্যালেঞ্জে পড়েছে। মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিবেচনাকে বাদ দিয়ে যে কারখানা চালু রাখা যায় না, চীনে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বন্ধঘোষিত শত শত কারখানা তার সাক্ষ্য হলো। করোনাভাইরাস কেবল বিশ্বব্যবস্থার ধরনই নয়, হয়তো অনেক সামাজিক মূল্যবোধই আমূল পাল্টে দিতে বসেছে।
বিশ্বব্যাপী নানা গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশে অপেক্ষাকৃত কম হতে পারে সংক্রমণ। কিন্তু আমেরিকার লুজিয়ানা এবং মিয়ামি বর্তমানে উষ্ণ হলেও রোগীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনে অজানা কারণে নিউমোনিয়া রোগী শনাক্ত হয় এবং ১১ জানুয়ারি ২০২০ প্রথম রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জানুয়ারি ৩০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করে। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাসকে কোভিড-১৯ হিসেবে নামকরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম থেকেই সময়োচিত গাইডলাইন এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমেই বলেছে, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা বাড়াতে। এটা অনুসরণ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর অনেকটাই সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই সময়োচিত দিকনির্দেশনা দিয়ে চলেছে। প্রথমেই তারা বলেছে পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। দ্বিতীয়ত, বলেছে সন্দেহভাজন ব্যক্তি (সোর্স) পৃথকীকরণ, পরীক্ষা করা আর পর্যাপ্ত চিকিৎসা প্রদান। সর্বশেষ স্বাস্থ্য সংস্থা ৬টি পরামর্শ দিয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর শিকার দেশগুলোর মধ্য উত্থান-পতন থেমে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবার পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠে গেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। তবে করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্তের সংখ্যার দিক দিয়ে এখন শীর্ষস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির মোট জনগোষ্ঠির ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এখন ‘ঘরবন্দি’। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঘরের বাইরে সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। করোনার বিস্তার ঠেকাতে কেবল জরুরি সেবা ছাড়া স্কুলসহ বেশিরভাগ অফিস-আদালত এক মাসের জন্য বন্ধ করেছে সিঙ্গাপুর। ইউরোপের মতো পরিস্থিতি এশিয়া বা আমাদের দেশে হয়নি বা হবে না- এমনটি যারা ভেবেছিলেন তারা আজ খামোশ হয়ে গেছেন। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৫০ জন আক্রান্ত ও ৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিৎ করা করোনার ছোবলে পড়ার ঘটনা তারা মেলাতে পারছেন না।
অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানোর পরিণতিতে বর্তমানে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর একক আর কোনো উপায় নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাস সম্পর্কে অভিন্ন তথ্যও আসেনি। তবে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আধুনিক-অনাধুনিক সব মহল থেকে যে অভিন্ন কথাটি আসছে সেটি হলো- করোনা নতুন রোগ। আবার এমনও নয়, এটা কোন মৌসুমী রোগ, দিন কতক পরেই চলে যাবে। একবার যখন এসেছে, হয়তো থেকেই যাবে। হয়তো একে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে, শিগগিরই চলে যাবে, সেটি মনে করা যাচ্ছে না। এইচআইভি, সার্স, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু- এই সব ভাইরাসের মতো এটিও থেকে যেতে পারে, সেই শঙ্কা অনেকের। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়েছেন, এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বড়জোর ৩ শতাংশের মত মানুষ মারা যায়। এমন তথ্যে কিছুদিন একটা ভরসা পেলেও মৃত্যুর লক্ষণে সেটা কেটে গিয়ে আতঙ্কই মুখ্য হয়ে উঠছে। কেউ তো জানে না, আক্রান্ত হলে তার অবস্থান কোথায় হবে? ওই তিন শতাংশের মধ্যে না বাইরে? কে দেবে সেই গ্যারান্টি?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট