মিতা চোখ মুছছে। টপটপ করে পানি পড়ছে। এই মুহূর্তে হয়তো পানি পড়াটা ঠিক হচ্ছেনা। থেমে যাওয়া উচিৎ। কিছুক্ষণ আগে মিতার দাদি মারা গেছে। যে দাদির কোলে মিতা বড় হয়েছে। মায়ের পক্ষাঘাতগ্রস্ততায় যে দাদিই ছিলো মিতার আশ্রয়।
দাদি অবশ্য মিতার চেয়ে কামাল আর নাজিমকেই বেশি ভালোবাসতো৷ কামাল আর নাজিম মিতার চাচাতো ভাই৷ তবু ওদের সাথে বসলে মিতাও কিছু আদরের ভাগ পেয়ে যেতো৷ পেয়ে যেতো সকালের দুধ রুটি, দুপুরের গুড় মুড়ি, বিকেলের ভাত তরকারি ইত্যাদি ইত্যাদি। পেয়ে যেতো জ্বীন পরী দৈত্যের গল্প, রেডিওতে বাজতে থাকা বাংলা সিনেমার গান, দাদার বড় কালো চেয়ারে টুপ করে বসে পড়ার একটু সুযোগ।
মিতার নাম রেখেছিলেন মিতার দাদিই। মিতার চেহারার সাথেও তার দাদির চেহারার অদ্ভুত মিল৷ মিলটা অবশ্য মিতা ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেনা। কে জানে, জীবনের মিলগুলো কেউ খেয়াল করে কিনা।
চোখ মুছে মিতা কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করছে। কাজ বলতে আর তেমন কী! দিব্যি এসি চলছে। এতো শোকেও ঘাম হচ্ছেনা। ঘরে নরোম আলো। নরোম বিছানা।
মিতার গা হালকা কাঁপছে। এই জায়গাটায় মিতা বহুবার এসেছে। কিছু আজ সব কেমন ঘোলাটে অপরিচিত লাগছে। বাথরুমের সাদা তোয়ালেটা বিছানার ওপর থেকে সবুজ লাগছে। সাইড টেবিলে রাখা কমলা প্লাস্টিকের পানির বোতলটা হঠাৎ নীল হয়ে গেছে৷ মিতার নিজেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
একে একে সব ভেসে আসছে। শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কিছুকাল… পুরোটা জীবন।
হ্যাঁ, মিতাকে এখনো যুবতীই বলা যায়। ২৬ বছরের যুবতী। গড়পড়তা গড়ন, গায়ের রঙ। অসুন্দর বলা যায় না তাকে। বরং একটু স্নো পাউডার, ঠোঁটে একটু রঙ, একটু কাজলে তাকে বেশ মোহনীয়ই লাগে। কলেজে পড়ার সময় একবার এক বন্ধু তাকে বলেছিলো, মিতার গলার কাছটা নাকি ভীষণ সুন্দর। হাড়গুলো। ওদের বলে সুইট বোন। কোন পুরুষ দেখলে নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
মিতা হাসতো। মিতার হাসি সুন্দর। আয়নায় শুধুমাত্র নিজের হাসি দেখেই সে মুগ্ধ হয়। আরও একজন হয়েছিলো। রাসেল। মিতার অধরা প্রেম।
সাইকেল চালিয়ে মিতার পেছনে ঘুরে বেড়াতো ছেলেটা। হালকা গোঁফ দাড়ি উঠতে শুরু করেছে তখন রাসেলের। বড়জোর এক দেড় বছরের সিনিয়র ছিলো মিতার। দু ক্লাস উপরে পড়তো। গোলাপ দিতো, চিঠি দিতো, হাতে কলম দিয়ে R+M লিখে দিতো।
মিতা লজ্জা পেতো। কিচ্ছু বলতো না। শুধু মাঝেমধ্যে টিফিন বক্সে পাউরুটি ভেজে ডিম বা জেলি মাখিয়ে আনতো। কখনো আনতো নুডুলস বা ভাত ভাজা। মাতৃহীন রাসেল আনত মুখে খেয়ে নিতো। তারপর কৃতজ্ঞ চোখে মিতার দিকে তাকাতো। মিতার খুব কান্না পেতো। রাত হলে অতো মশার কামড়ে, অতো ইঁদুরের কিচকিচ শব্দের মধ্যে, অতো গরমে, গায়ে বোনের পা তুলে দেয়া অবস্থায়, পাশের ঘরে বাবার নাক ডাকা শুনতে শুনতেও রাসেলের সেই আনত মুখ, সেই কৃতজ্ঞ চোখ মিতার মাথায় ঘুরতো। বুকটা ধুকপুক করতো। ক্যামন যেনো এক অদ্ভুত ভালোলাগার একটা স্রোত নেমে যেতো গা বেয়ে…
আজ এতোদিন পরেও সেই স্রোতটা মিতা মনে করতে পারে। একলা থাকলে সেই একই ভালোলাগায় ভেসে যেতে পারে। অস্পর্শ প্রেমের মতোন শুদ্ধ কিছু জগতে নাই।
আজ এতোদিন পরেও সেই স্রোতটা মিতা মনে করতে পারে। একলা থাকলে সেই একই ভালোলাগায় ভেসে যেতে পারে। অস্পর্শ প্রেমের মতোন শুদ্ধ কিছু জগতে নাই।
মিতার ঘোর কাটে। এক ঘোর থেকে মিতা আরেক ঘোরে পড়ে। পরতে পরতে কাজ করার চেষ্টা করে। কাজ কার কী! তেমন কোন পরিশ্রম না। রোজকার মতোই৷ কিন্তু রাসেলের বাবা ট্রান্সফার না হলে, রাসেল তার জীবনে থাকলে, রাসেল তাকে ভুলে না গেলে মিতার জীবন কি অন্যরকম হতো না? আচ্ছা, ইউনিফর্মের উপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে রাসেলকে যদি মিতা তার সুইট বোন দুটো দেখাতো, তবুও কি রাসেল তাকে ভুলে যেতো?
তবে মিতার জীবন হয়তো রাসেলের চলে যাওয়ায় পালটায়নি। পাল্টেছে মিতার বাপটা মরে যাওয়ায়। পাল্টেছে মিতার চাচার ছোট ছেলে নাজিম তার গায়ে হাত দেয়ায়, এই কারণে চাচাদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায়। পাল্টেছে অনার্সটা শেষ করতে না পারায়। পাল্টেছে…
মিতা ভাবতে চায় না। এতোকিছু ভাবতে তার ভালো লাগে না। সে কাজে মন দিতে চায়। মন হয়তো আসে না। অবশ্য জগতে বেশিরভাগ কাজেই আসলে মন লাগেনা। লাগে পরিশ্রম। মিতা পরিশ্রমে ভয় পায় না। শুধু আজ বারবার খেয়ালী হয়ে যাচ্ছে৷ নিজেকে আটকাতে পারছেনা।
অথচ মিতা কিন্তু অনেক কিছু পারে। সুন্দর করে বাংলা পড়তে পারে। যা পড়ে তাই কবিতার মতোন শোনায়। রাঁধতে জানে। কাপড়ে সুতার ফুল তুলতে জানে। শার্টের বোতাম লাগাতে জানে৷ মায়ের সেবা করে। ছোটবোনের স্কুলের খরচা দেয়। একটা চিরায়ত বাঙলার মেয়ের সব বৈশিষ্ট্যই আছে তার মধ্যে। আছে কারো সঙ্গী হবার ধরণটাও। শুধু ইচ্ছেটা আর নাই। হয়তো যোগ্যতাটাও।
একটা বাপ মরা, প্যারালাইজড মায়ের ইন্টারপাশ গরীব বেশ্যা। হ্যাঁ, মিতা বেশ্যা। দেহ বিক্রি করে তার সংসার চলে। তার মায়ের ওষুধ কেনা হয়। বোনের বই খাতা কেনা হয়৷ চাল ডাল পেঁয়াজ কেনা হয়। পরনের কাপড় কেনা হয়। এইযে দাদী মরে যাওয়ার খবর পেয়ে মিতার হাত থেকে তার কমদামী মোবাইল ফোনটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে, সেটাও কিনতে হবে দেহ বিক্রির টাকা দিয়েই।
একদিন চাচাতো ভাই ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলো বলে যে মেয়েটি মাথা উঁচু করে মা বোনকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো, আজ অনেকদিন হয় সেই মেয়েটিই রোজ এর তার নিচে শুয়ে যাচ্ছে। তার মাথা নত। তার চোখ আনত।
দাদি সেদিন কিছুই বলেনি। যেদিন মিতারা বাপের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে এসেছিলো। চুপ করে শক্ত হয়ে দাদার পুরাতন বড় চেয়ারটায় বসে ছিলো। সেই দাদির জন্য আজ মিতার চোখ, তার সুইট বোন, খোলা বুক, সব ভিজে একাকার হচ্ছে। সে কাজ করতে পারছেনা। যে কাজে তার পেট চলে।