নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার সম্ভাবনাময় ও নতুন কিংবা প্রারম্ভিক পর্যায়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে তাদের ব্যবসার বিকাশে সহায়তা করে। মূলত এটি এক ধরনের উদ্যোক্তা সহায়ক কেন্দ্র।
ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের ব্যবসার বিকাশ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু সমাধানে সহায়তা করা হয়, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবসা এবং প্রযুক্তিগত সেবা, প্রাথমিক তহবিল, ল্যাব সুবিধা, পরামর্শ, নেটওয়ার্ক এবং বাজার সংযোগে সহায়তা প্রদান করা হয়। ইনকিউবেশন সেন্টার সাধারণত সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থা বা পাবলিক প্রতিষ্ঠান যেমন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালনা করা হয়।
ইনকিউবেশন সেন্টারের মূল লক্ষ্য হলো তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সেবা প্রদান করে তাদের ব্যবসায়িক পরিধি বৃদ্ধি করা। ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে ব্যবসায়িক ধারণা বিকাশ লাভ করে এবং তহবিলের উৎস, মানবশক্তি ও সম্ভাব্য বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিকল্পনা তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও উন্নয়নের বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ১৯৫৯ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাটাভিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টারের মাধ্যমে ইনকিউবেশন সেন্টারসংক্রান্ত উদ্যোগ সর্বপ্রথম সফলভাবে শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ইনকিউবেটর স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নজির স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০ হাজার আইটি বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে দেড় হাজারের বেশি এরকম বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার রয়েছে; আর চীনে বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তর/প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে সরকারি পর্যায়ে আইসিটি বিভাগের মাধ্যমে ২০১২ সালের দিকে ইনকিউবেটর স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয় এবং বেসরকারি উদ্যোগে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃক বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়।
এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এ সম্ভাবনাময় ক্লাস্টারগুলোতে ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন ও কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার স্থাপনের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই আলোকে এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক বিভাগে এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার পরিচালনায় একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করা হয়েছে। এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার থেকে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে ওয়ার্কিং স্পেস, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা, ব্যবসায় নেটওয়ার্কিং, প্রশিক্ষণ, মার্কেট লিংকেজ ও নতুন মার্কেটপ্রাপ্তি, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, বিজনেস অ্যাডভাইজরি সেবা, সভাকক্ষ ব্যবহার, ঋণ সহায়তা, পলিসি, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, লিগ্যাল ইস্যুতে সহায়তা, সাপ্তাহিক উদ্যোক্তা আড্ডাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হচ্ছে, যা উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারে ১৫টি ওয়ার্কস্পেস, একটি অনলাইন বিজনেস ল্যাব, একটি প্রশিক্ষণ রুম, দুটি সভাকক্ষ এবং একটি কনফারেন্স রুম সুবিধা রয়েছে। ইনকিউবিটিরা তাদের প্রয়োজনে অনুমোদনসাপেক্ষে এসব সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। জানুয়ারি-জুন ২০২২ সময়ে বাস্তবায়িত এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারের ১ম ব্যাচের মাধ্যমে ১১ জন নতুন উদ্যোক্তাকে ইনকিউবিটি হিসাবে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের অনেকেই সফল উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়েছে।
আগস্টে শুরু হওয়া ২য় ব্যাচের ১৭ জন নতুন উদ্যোক্তাকে বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে ইনকিউবিটি হিসাবে সার্বিক সহায়তা প্রদান করার কাজ চলমান রয়েছে। ২য় ব্যাচের অন্যতম ইনকিউবিটি ফাইমা সুলতানা লোপা প্রোডাক্ট অ্যান্ড ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিং বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চামড়াজাত পণ্য তৈরি ও বিপণনের ওপর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন।
এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে তিনি তার ব্যবসা পরিকল্পনা তৈরি, চামড়াজাত পণ্য তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ, ব্যাংক লোন পাওয়ার সহজ মাধ্যম এবং পণ্য বিপণনের ওপর পরিপূর্ণ ধারণা পেতে সক্ষম হয়েছেন। ২য় ব্যাচের আরেক ইনকিউবিটি মাহফুজুল গণি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অনার্স সম্পন্ন করে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন।
এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারে সংশ্লিষ্ট খাতের কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার পরামর্শ ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তিনি পণ্য বিপণন ও রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করে সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার পথ খুঁজে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
সরকার জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫ সময়ে নতুন ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২৫) প্রণয়ন করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এমএসএমই খাতের উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি-২০৩০ ও ভিশন ২০৪১ অর্জন করা সম্ভব নয়।
কারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও টেকসই শিল্পায়নের মূল চাবিকাঠি এমএসএমই খাত। একমাত্র এমএসএমই খাতের উন্নয়ন হলেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এসএমই বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়