শরিফ ইসলাম,যশোর ব্যুরো : যশোর শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা খুলনা বাসস্ট্যান্ডের কাছে বড় মসজিদের গেটে একটি খুপরি ঘরে তখন আলুপুরি বানাচ্ছিলেন দুজন। পাশের কড়াইতে ভাজা হচ্ছে সেই আলুপুরি। ভাজার পর আলুপুরি রাখা হচ্ছে সামনে কাচ দিয়ে ঘেরা কাঠের বড় বাক্সে। বাক্সের পেছনে দাঁড়িয়ে দুজন চাহিদামতো আলুপুরি ছোট বাটিতে রেখে বাটি তুলে দিচ্ছেন ক্রেতার হাতে। দাঁড়িয়ে ক্রেতা খাচ্ছেন বশির শেখের আলুপুরি। ৪০ বছর ধরে তিনি আলুপুরি বানান।
যেখানে দোকানটির অবস্থান, তার আশপাশে আছে মণিহার সিনেমা হল, ঢাকা, বরিশাল, রংপুরসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পরিবহনের কাউন্টার, কেশবপুর বাসস্ট্যান্ড, নড়াইল বাসস্ট্যান্ড, মোটর পার্টস ব্যবসায়ীদের দোকান। আছে নানা গ্যারেজ। প্রতিনিয়ত এখানে হাজারো মানুষের পদচারণ।
বশিরের দোকানে আলুপুরির পাশাপাশি তৈরি করা হয় কিছু আলুর চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি ও লুচি। লুচি দিয়ে খাওয়ার জন্য গামলায় রাখা হয়েছে বুটের ডাল। আর আছে এক গামলা সেদ্ধ ছোলা।
সম্প্রতি এক সকালে আলুপুরি তৈরি করতে করতে বশির শেখ বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে দোকান খুলি। এরপর কিছু লুচি বানাই, সঙ্গে বুটের ডাল। এগুলোর পরপরই তৈরি করি আলুপুরি। চলে রাত আটটা পর্যন্ত। দোকান বন্ধ করতে করতে রাত নয়টা বেজে যায়। প্রায় ৪০ বছর ধরে আলুপুরি বানাচ্ছি।’
খাবারের দরদাম সম্পর্কে বশির শেখ বলেন, লুচির সঙ্গে ডাল হলে ডালের দাম নেওয়া হয় পাঁচ টাকা। আর পুরির সঙ্গে ডাল ফ্রি। এর সঙ্গে যোগ করলেন, তাঁর দোকানের বেশির ভাগ পুরি বিক্রি হয় পার্সেলে। লোকজন খান আবার যাওয়ার সময় বাড়ি বা দোকানের জন্য নিয়ে যান। অনেকে এসব খাবার খাওয়ার পর চা পান করতে চান। এ জন্য বড় দুটি ফ্লাক্সে তিনি চা বানিয়ে রাখেন। তাঁর দোকানে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কাপ চা বিক্রি হয়।
প্রতিদিন রান্নাবান্নায় কী পরিমাণ পণ্য লাগে জানতে চাইলে বশির শেখ বলেন, প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ কেজি ময়দা, ২৫ কেজি আলু, ৯ থেকে ১০ লিটার পাম অয়েল, ৫ কেজি পেঁয়াজ, ৩ কেজি বেগুন, ৪ কেজি বেসন, ৩ কেজি ছোলা। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার পুরি, লুচি, আলুর চপ, বেগুনি ও পেঁয়াজু বিক্রি হয়। দোকানে চারজন কর্মচারী। মালামাল, কর্মচারীর মজুরি, দোকান ভাড়া ইত্যাদি দিয়ে দিনে গড়ে হাজার টাকা থাকে। জিনিসের দাম বাড়লেও আগের মতোই আলুপুরি, বেগুনি, পেঁয়াজু, আলুর চপ তিন টাকা করে বিক্রি করেন বলে জানালেন।
বশির শেখের বাবার নাম সরোয়ার জাহান। তিনি পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন। যশোর কোতোয়ালি থানার ভেতরে যে গণকবর, সেখানে তিনি শায়িত।
একটি বেঞ্চে বসে আলুপুরি খাচ্ছিলেন শহরের সিটি কলেজপাড়া এলাকার সিদ্দিক হোসেন (৫২)। তিনি বলেন, প্রায় ৩২ বছর ধরে তিনি এখানে আসেন পুরি খেতে। বশির মিয়ার তৈরি আলুপুরি বেশ ভালো। সঙ্গে ডাল দেন বলে খেতে ভালো লাগে। কলেজছাত্র দুই বন্ধু মো. আক্তারুজ্জামান ও আবদুর রহমানও আলুপুরি খেয়ে প্রশংসা করলেন।
বশির শেখের বয়স ৬০ বছর। ১৯৮০ সালের দিকে এই মোড়ে ছিল মন্টুর পুরির দোকান। সেই দোকানে কাজ করতেন বশির। আলুপুরি তৈরির কাজ তাঁর কাছেই শিখেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালের দিকে তিনি পাশেই একটা চালা তুলে আলুপুরি তৈরি শুরু করেন। তখন ভাড়া বাবদ মাসে মসজিদ কমিটিকে ১ টাকা দিতে হতো। এখন দিতে হয় ৭০০ টাকা।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার বশির শেখ বলেন, তিনি যশোর শহরের নাজির শংকরপুর এলাকায় তিন কাঠা জমি কিনেছেন। সেখানে টিনের ছাউনি দিয়ে ইটের ঘর করে থাকেন। তাঁর দুই ছেলে আর চার মেয়ে। ছেলেমেয়েদের সবার বিয়ে হয়েছে। তবে আলুপুরির দোকানটি এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হতে পারে, সব সময় এমন শঙ্কায় থাকেন তিনি।