এস.ইসলাম, যশোর জেলা প্রতিনিধি : ‘দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হলেও রাজাকারমুক্ত হয়নি প্রেমচারা। আর কবে স্বাধীন হবে এই গ্রাম। কবে এ গ্রামের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধিন মানবতা ও যুদ্ধপরাধী মামলার জামিনে মুক্ত হওয়া রাজাকার আমজাদ নামে খ্যাত আমজাদ হোসেন মোল্লাসহ তার দোসরদের হাতে হত্যার শিকার, অত্যাচার ও অব্যাহত হামলা ও হুমকির শিকার ভুক্তভোগীরা এভাবেই অভিমত জানালেন।
১৯ মার্চ ২০২১ সরেজমিনে যশোর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে যুদ্ধাপরাধী আমজাদ হোসেন মোল্যার জামিন ও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান বিষয়ে জানতে চাইলে এভাবেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তারা। তারা জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করায় আমজাদ হোসেন মোল্লা ও তার দোসর আদম ব্যবসায়ী মহাসীন বিশ্বাস গংদের অব্যাহত অত্যাচারে ভীত সন্ত্রস্ত্র।
রাজাকারের হাতে পিতা হত্যার বিচার চেয়ে কি এতই অপরাধ করেছি যে, আমরা পেট ভরে দু’বেলা খেতে তো পারবই না একটু নিরাপদে থাকব তাও জুটবে না আমাদের কপালে। পিতা হত্যার বিচার চাওয়া কী অপরাধ। ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করেন নইলে আমাদের মেরে রেখে যান’ কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা ব্যাক্ত করলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়–য়াকান্দি গ্রামের খলিলুর রহমান খোকন বিশ্বাস ও তার পরিবারের সদস্যরা। সাংবাদিকদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারটির ছোটবড় সদস্যরা।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঘারপাড়ার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আমজাদ হোসেন মোল্যার বিরুদ্ধে পিতা রজব আলী বিশ্বাসকে হত্যা মামলা দায়েরের পর থেকে আমজাদ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধামকি আর নির্যাতনের শিকার পরিবারটির ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে গত দুই ফেব্রুয়ারি করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির মামলা।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার প্রেমচারা গ্রামের মহাসীন বিশ্বাসের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে খোকন বিশ্বাস, তার ভাই আবুল বিশ্বাস ও পরিবারের অপর তিন সদস্য। এবং এক লাখ টাকা চাঁদা আদায়ও করেছে তারা হুমকি দিয়ে। যেখানে বিগত ২০১৭ সাল থেকে আমজাদ রাজাকারের অন্যতম সহযোগী আদম ব্যবসায়ী এই মহাসীন বিশ্বাসসহ অপরাপর সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধামকি নির্যাতনে তটস্থ হয়ে দিন পার করছে পরিবারটি। জীর্ণ কুটিরে বসবাস করা দিন আনা দিন খাওয়া সেই পরিবারটি কিভাবে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করতে পারে বা ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার বিষয়টি কল্পকাহিনীকেও হার মানাবে বলে মনে হয় উপস্থিত সকলের। বরং পরিবারটির কান্নায় চোখ ভিজে ওঠে উপস্থিত সকলের।
কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে তাই খোকন বিশ্বাস তার ভাই আবুল বিশ্বাস এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানরা বারবার একটি কথায় বলতে থাকে ‘আমাদের জন্য কিছু করেন নইলে আমাদের মেরে রেখে যান’।
তারা বলেন, তাহলে আমরা কোথায় যাবো কি করবো। কার কাছে বিচার চাইবো। অসহায়ের ত্রাতা জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশে কি আজও রাজাকার আর তার দোসররা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর আমাদেরকে যেভাবে খুশি সেভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। আমরা একটু বাঁচতে চাই আমাদের পিতার হত্যার বিচার চাই। দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা কেঁদে চলেছি আর যে পারিনা বাপু এবার একটা কিছু করেন। প্রশাসনকে আপনারা বলেন- তারা যেন মহাসীন বিশ্বাস, আলম মোল্যা, টুকুল মন্ডলদের মত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
এদিকে আমজাদ হোসেন মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে একাত্তরে নৃশংসভাবে খুন হওয়া দুই ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে হাউমাউ করে শিশুর মত কেঁদে উঠলেন বিরাশি বছরের বৃদ্ধ আলাউদ্দীন বিশ্বাস। বুক চাপড়ে কাঁদছেন আর বলছেন ‘ওরে ভাই আমার ওরে ভাই আমার।’ তার আহাজারি ভারাক্রান্ত করে তোলে পরিবেশ।
তিনি বলেই চলেন- দুই ভাই আয়েন উদ্দীন আয়না ও ময়েন উদ্দীন ময়না হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করার পর থেকে আমজাদ বাহিনী বাড়িতে হামলা করছে, হুমকি-ধামকি দিয়েই যাচ্ছে আমজাদ রাজাকার আর তার দোসররা। আমার সাক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা করছে। পরিবার-পরিজন আত্মীয় স্বজনদের এমন কেউ নেই যাদের নামে একাধিক মামলা করেনি রাজাকারদের দোসররা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার দুই ভাইকে মেরেছে, আমার চাচাকে মেরেছে আমজাদ রাজাকার ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। বিচার চেয়ে মামলা করার পর থেকেই মরতে বসেছি আমরা। রাজাকারের সহযোগী মহাসীন বিশ্বাস, টুটুল মন্ডল, শওকত মন্ডল, আলম মোল্যারা বারবার হুমকি দেয়। সাক্ষীরা আর সাক্ষ্য দিতে যেতে চায় না। কিভাবে যাবে তারা যখন দেখে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার গাড়িতে হামলা করেও কিছু হয়না ওই সব সন্ত্রাসীদের তখন ভয় না পেয়ে জীবনের মায়া না করে উপায় কী।’
তিনি হাউমাউ করে কেঁদে বলেন ‘ভাইদের তো কুপিয়ে মেরেছে সেই ’৭১ সালে। আর আমাদেরকে না মেরে নির্যাতন করে তিলে তিলে মারার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটা মুহূর্ত তটস্থ থাকতে হয় কখন কী হয় এ ভয়ে।
রাজাকার আমজাদ নামে খ্যাত আমজাদ হোসেন মোল্লা বর্তমান সহযোগী মহাসীন বিশ্বাসের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অপর এক সাক্ষী বাঘারপাড়ার প্রেমচারা গ্রামের এহিয়ার রহমান মোল্যা বলেন, আমজাদ রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে ভাইকে হারিয়েছি, ভাই-ভাইপোকে কুপিয়ে জখম করেছে আমজাদ রাজাকারের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা, পোতা ছেলে-নাতি ছেলে ভাইকে আসামি করা হয়েছে ১৬ টি মামলায়। দোকান ভাংচুর করেছে বাড়িতে আগুন দিয়েছে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে আমাকে। সারাদিন পথ চলতে হয় পুলিশ সাথে করে নিয়ে। এটা কী কোন জীবন। এভাবে কী বেঁচে থাকা যায়? দেশে যখন সকল পর্যায়ের বড় বড় অপরাধীরা ধরা পড়ছে বিচার হচ্ছে তখন প্রেমচারার সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এখন তো আমজাদ মোল্যা জামিনে বাইরে তাই ওই সব সন্ত্রাসীদের ত্রাসের মাত্রা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তারা প্রতিনিয়ত বলে বেড়াচ্ছে দাঁড়া এই তো আমজাদ আসছে গ্রামে তারপর দেখ তোদের কী হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত জীবন শংকায় বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।
১৯৭১ সালে আমজাদ রাজাকার স্থানীয় যে আম বাগানে রজব আলী বিশ্বাসকে হত্যা করে সেই আম বাগানের মালিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অপর সাক্ষী ইসহাক মোল্যা বলেন, ‘আজ আদালতে সাক্ষী দিয়েছি বলে আমার নাতি-পোতারা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার চেয়ে বারবার প্রশাসনের কাছে গেলেও মহাসীন-টুকুল-আলম মোল্যা বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আমাদেরকে পুলিশ দিয়ে পাহারা দেয়া হচ্ছে কিন্তু সন্ত্রাসীদের ধরা হচ্ছে না। পুলিশ পাহারা নিয়ে বুকভরা ভয় নিয়ে কী জীবন কাটানো যায়?’
উল্লেখ্য, এই মহাসীন বিশ্বাস এতটা বেপরোয়া যে, রাজাকার আমজাদ হোসেন মোল্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা তদন্ত চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক খানের গাড়িবহরে হামলা করে মহাসীন বিশ্বাসের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী। এ ঘটনায় আব্দুর রাজ্জাক খান বাদী হয়ে বাঘারপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। যেখানে প্রধান আসামি করা হয় মহাসীন বিশ্বাসকে। এমনকি মহাসীন বিশ্বাস নয় তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন মুন্নার নেতৃত্বে একটি সন্ত্রাসী দল ২০১৯ সালের তিন জুন যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার প্রেমচারা গ্রামে অবস্থিত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের উপর হামলা করে। যে বিষয়ে বাঘারপাড়া থানায় মামলা হয়েছে।
আমজাদ রাজাকার গ্রেফতার হওয়ার পর হুমকি-ধামকি কিছুটা কমলেও বর্তমানে আমজাদ রাজাকার জামিনে বাইরে আসার সাথে সাথে তার সন্ত্রাসী বাহিনী আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রেমচারার মহাসীন বিশ্বাসের নেতৃত্বে তারা নতুন করে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। আমাদেরকে কোণঠাসা করে ভয় ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য প্রদান থেকে বিরত রাখার জন্য সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য বারবার প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশে কাছে সহযোগিতা চেয়ে থানায় জিডি করেছি। সন্ত্রাসীরা তাতে আরো বেপরোয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধী আমজাদ হোসেন মোল্যা ও তার সহযোগীদের হাতে নিহত ডা. নওফেল উদ্দীনের ছেলে বিএম রুহুল আমিন বলেন, আমার বাবাকে ও আর চাচাতো ভাই ভাই আয়েন উদ্দীন আয়না ও ময়েন উদ্দীন ময়নাকে হত্যা করেছে আমজাদ রাজাকার। তার বিচার চেয়ে মামলা করেছি। কিন্তু এখন আমরাই জীবন সংকটে। মামলার পর থেকে প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকি পেয়ে আসছি। আর এখন আমজাদ রাজাকার জামিন পাওয়ায় তার মাত্রা আরো বেড়েছে।
আমজাদ রাজাকারের জামিন পরবর্তী সময়ে তার পোষ্য সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন বিষয়ে কথা হয় বন্দবিলা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে সাবেক মেম্বার আব্দুল হালিম বিশ্বাসের সাথে তিনি বলেন, আমজাদ ভাই ফোনে কথা বলেছেন আমার সাথে। তিনি বলেছেন, ‘এই চিন্তা করিস না। এইতো আমি আসছি তোরা মহাসীন বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ রাখিস ও যেভাবে যা করতে বলে তাই করিস।’ একই কথা বলেন, আমজাদ রাজাকারের সাথে ফোনে যোগাযোগ হওয়া সিদ্দিক মোল্যা ও মফিজ মিয়া।
এ প্রসঙ্গে যশোরের বাঘারপাড়া থানার ওসি ফিরোজ উদ্দিন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার সাক্ষীরা কয়েকটি জিডি করেছেন। বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি নিয়ে জিডিগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাদী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তারা গুরুত্বের সাথে দেখছেন।