সড়ক দুর্ঘটনা : পুরো প্রক্রিয়ায় বদল আনতে হবে : নজরদারি বাড়ালে সড়কে মৃত্যু কমবে
|
মামুনুর রশীদ নোমানী: সম্প্রতি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ। এর পেছনে চালকদের বেপরোয়া আচরণসহ সড়কে অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও আইনের প্রয়োগের অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রকৌশলগত কিছু সমস্যার সমাধান এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ালে সড়কে মৃত্যু কমবে। পরোপকারী হিসেবে সুনাম ছিল বরিশালের সাংবাদিক মাসুদ রানার। এক বন্ধুর ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় অন্য পাঁচজনের সঙ্গে প্রাণ গেল তারও। প্রিয় মানুষটির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার বন্ধুরা; তাকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে গেছেন আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের লখারমাটিয়া গ্রামে। সবার চোখ অশ্রুসজল।
আরও পড়ুন: বন্ধুর মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সাংবাদিক মাসুদ রানা ফিরলেন লাশ হয়ে
মঙ্গলবার ৪টার দিকে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মাসেতু দক্ষিণ থানার কাছাকাছি এলাকায় পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে একটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা খেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছয় আরোহীর প্রাণ যায়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা এত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো- আইন প্রয়োগের অভাব, সমন্বয়হীনতা, চালকদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি। এ ছাড়া প্রতিযোগিতা, মহাসড়কে নসিমন, ইজিবাইক, রিকশাসহ ছোট যানবাহনের চলাচল এবং পথচারীদের অসচেনতাও দায়ী। আরও পড়ুন: অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় ‘পরোপকারী’ রাব্বির মৃত্যু, শোকে স্তব্ধ এলাকাবাসী
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব দুর্ঘটনার পেছনে প্রকৌশলগত কিছু কারণ রয়েছে। সড়ক তৈরিতে সমন্বয়হীনতা, নির্মাণের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিও অন্যতম কারণ।’ ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছন ৯ হাজার ৯৫১ জন। আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এর মধ্যে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত, ২০১ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
আরও পড়ুন: মাকে নিয়ে আমেরিকা ফেরা হলো না লিমার
‘দূরপাল্লার গণপরিবহনে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে’ উল্লেখ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এর পেছনে কিছু কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো হলো— বেপরোয়া গতি, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা সড়কবাতি না থাকা, জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকা, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। উল্টোপথে যান চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি ও পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহনও বড় কারণ। এছাড়া, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ডিভাইডার বিহীন রাস্তাগুলোতে হয়েছে। আমাদের চালকদের যে আচরণ, তাতে সব রাস্তায় ডিভাইডার লাগবে। পথচারীর জন্য নিরাপদ ফুটপাত না থাকায়ও মৃত্যু বাড়ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারকে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও মনোযোগী হতে হবে।’ দুর্ঘটনার শিকার যানবাহনের ক্ষতি কত হয়, তা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, এ বিষয়টি সরকার আমলে নিচ্ছে না, শুধু তার লোকজন নীতিনির্ধারণী জায়গায় বসে থাকার কারণে। তা নাহলে, আইন করেও কেন তা কার্যকর হবে না? এখানেই সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে অধিকাংশ চালককে ঘুষ দিয়ে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হতো না। হাইওয়ে পুলিশ যদি¡ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করত তবে, গাড়ি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারত না। মোটরযান আইনে জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার, ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সার্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে শহর ও লোকালয়ে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ৫০ কিলোমিটার। মহাসড়ক ও শহরের যানবাহনের গতির দিকে তাকালে গতিসীমার এ আইন যে কেউ মানছে না বা কর্তব্যরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ মানানোর যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাস-ট্রাকের অনেক চালক বলেছেন, তাদের প্রায় সব চালকই ট্রিপ অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। তারা মাসিক বেতনভুক্ত নন। এজন্য ট্রিপ বাড়ানোর জন্য পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো হয়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ট্রিপ বাড়িয়ে বাড়তি রোজগারের জন্য তারা শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকিই নিচ্ছে না, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাব, মাদকাসক্তি, মোবাইলে কথা বলা, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের ত্রুটি ও যথাযথ সংস্কারের অভাব, আইনের কার্যকর প্রয়োগ না হওয়াÑএসব কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করতে পারলেই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। কাজেই শনাক্তকৃত কারণ দূর করতে এবং পরিবহন খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। মূল সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পরিবহন সংগঠন ও মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্ধারণ, বিআরটিএ’র দক্ষতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন নিষিদ্ধ বা বিকল্প সড়ক নির্মাণ করতে হবে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বা দুটি গাড়ির মালিকদেরসহ অন্যান্য পরিবহন কোম্পানীকে একটি বড় কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশেই মালিকদের সমন্বয়ে বড় কোম্পানি গঠন করে পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। এতে চালক ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সারা দেশের চালকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে চালকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সড়কের নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য চালক ও যাত্রীদের বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশে শতকরা ৭০ ভাগ যাত্রী সড়ক পরিবহনে যাতায়াত করে। সড়ক পরিবহনে এত যাত্রী খুব কম দেশেই দেখা যায়। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহনের উপর থেকে চাপ কমাতে হবে। এজন্য রেল ও নৌপথকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। রেলকে যাত্রীদের কাছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বাংলাদেশে রেলের বিপুল সম্পত্তি ও বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এবং সেবার মান বৃদ্ধি করে যাত্রীদের রেল ভ্রমণে উৎসাহী করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ সবসময়ের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তখনই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে সঠিক তথ্যই নেই। নেই উদ্যোগও। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সরকারি তথ্যের উৎস পুলিশ। সড়ক দুর্ঘটনার পর মামলা হলেই পুলিশ তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। ভুক্তভোগী কেউ মামলা না করলে কিংবা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে ফেললে পুলিশের খাতায় কোনো তথ্য থাকে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত, ধরন ও কারণ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় পরিকল্পনা প্রণয়নে ঘাটতি থেকে যায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
মামুনুর রশীদ নোমানী, সম্পাদক ও প্রকাশক, বরিশাল খবর। সমন্বয়ক,সেভ দ্য রোড,বরিশাল শাখা। |