মামুনুর রশীদ নোমানী:
সম্প্রতি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ। এর পেছনে চালকদের বেপরোয়া আচরণসহ সড়কে অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও আইনের প্রয়োগের অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রকৌশলগত কিছু সমস্যার সমাধান এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ালে সড়কে মৃত্যু কমবে।
পরোপকারী হিসেবে সুনাম ছিল বরিশালের সাংবাদিক মাসুদ রানার। এক বন্ধুর ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় অন্য পাঁচজনের সঙ্গে প্রাণ গেল তারও।
প্রিয় মানুষটির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার বন্ধুরা; তাকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে গেছেন আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের লখারমাটিয়া গ্রামে। সবার চোখ অশ্রুসজল।
মঙ্গলবার ৪টার দিকে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মাসেতু দক্ষিণ থানার কাছাকাছি এলাকায় পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে একটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা খেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছয় আরোহীর প্রাণ যায়।
তারা হলেন- পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আমেরিকা প্রবাসী লতিফ মল্লিকের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৫৫), তার মেয়ে লুৎফুন্নাহার লিমা (২৮), দৈনিক নবচেতনা পত্রিকার বরিশাল ব্যুরো প্রধান সাংবাদিক মাসুদ রানা (৩০), পটুয়াখালীর দশমিনার আদমপুর এলাকার আব্দুল রাজ্জাক মল্লিকের ছেলে ফজলে রাব্বি (২৮), মাদারীপুরের মস্তফাপুর এলাকার অ্যাম্বুলেন্স চালক জিলানি (২৮) এবং খুলনার দীঘলিয়ার চন্দনিমহল ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অ্যাম্বুলেন্স চালকের সহকারী রবিউল ইসলাম (২৬)।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনা এত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো- আইন প্রয়োগের অভাব, সমন্বয়হীনতা, চালকদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি। এ ছাড়া প্রতিযোগিতা, মহাসড়কে নসিমন, ইজিবাইক, রিকশাসহ ছোট যানবাহনের চলাচল এবং পথচারীদের অসচেনতাও দায়ী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব দুর্ঘটনার পেছনে প্রকৌশলগত কিছু কারণ রয়েছে। সড়ক তৈরিতে সমন্বয়হীনতা, নির্মাণের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিও অন্যতম কারণ।’
তার পর্যবেক্ষণ, মোটাতাজা করা মহাসড়কের সঙ্গে গ্রামীণ সড়ককে সংযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এতে দ্রুত ও কম গতির যানবাহনের সংঘর্ষ হচ্ছে বেশি। বিপুল সংখ্যক যানযাবহনের ফিটনেস না থাকাতেও দুর্ঘটনা ঘটছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি প্রায় ৪০-৫০ লাখ অবৈধ যানও গুরুতর সমস্যা তৈরি করছে মহাসড়কে। মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কের সংযোগ বন্ধ করতে হবে। চার লেন রেখে সার্ভিস লেন বানাতে হবে।
২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছন ৯ হাজার ৯৫১ জন। আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এর মধ্যে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত, ২০১ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৭ হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছেন।
এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি।
২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ১০৪ জন নিহত হয়েছেন, যা ২০২১ সালের চেয়ে ৩ হাজার ১৩৫ জন বেশি বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।এ তথ্য তুলে ধরেন নিসচা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।সরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় তথ্য সংরক্ষণ ও প্রকাশের দাবি জানানো হয়
তিনি বলেন, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮ ভাগ বেশি মৃত্যু হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২১ সালে দেশব্যাপী ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬ হাজার ২৮৪ জন। আর আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন।
এরমধ্যে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। যা মোট নিহতের ৩৫.২৩ শতাংশ।
এছাড়া বছর জুড়ে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৪.২৩ শতাংশ।
‘দূরপাল্লার গণপরিবহনে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে’ উল্লেখ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এর পেছনে কিছু কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো হলো— বেপরোয়া গতি, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা সড়কবাতি না থাকা, জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকা, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা। উল্টোপথে যান চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি ও পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহনও বড় কারণ। এছাড়া, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেও দুর্ঘটনা বাড়ছে।
এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ডিভাইডার বিহীন রাস্তাগুলোতে হয়েছে। আমাদের চালকদের যে আচরণ, তাতে সব রাস্তায় ডিভাইডার লাগবে। পথচারীর জন্য নিরাপদ ফুটপাত না থাকায়ও মৃত্যু বাড়ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারকে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও মনোযোগী হতে হবে।’
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঝড়ে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনা আকস্মিক এবং তা প্রতিদিন ঘটে না, এমন কথা এখন আর খুব একটা মানসই না। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে, আবার কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। কোনোভাবেই দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সভা, সেমিনার, মানববন্ধন, মিছিল-মিটিং, তদন্ত কমিটি সবকিছু হলেও কার্যত ফলাফল শূন্য। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা মৃত্যুর মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে, তা আমরা কেউ বলতে পারি না। এবার ঈদে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেছে কয়েক শতাধিক মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও কম না। যাইহোক, এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
মনোযোগ
গাড়ি চালানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে মনোযোগ যেন গাড়ি এবং রাস্তার দিকেই থাকে। মনে রাখবেন একটু অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের কারণে ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
রোড স্ক্যানিং বা রাস্তা বিশ্লেষণ
রাস্তা বিশ্লেষণ বা রোড স্ক্যানিং নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ি চলানোর সময় অবশ্যই চলার রাস্তাটিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তা-সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল করতে হবে সেগুলো হলো- রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ, রাস্তার লেনের পরিমাণ, রাস্তার গঠনগত অবস্থা, রাস্তার প্রশস্ততা।
সিট বেল্ট বাঁধা
নিরাপদে গাড়ি চালানোর জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনে রাখবেন, শুধু আপনি নন আপনার সঙ্গে থাকা যাত্রীদেরও সিট বেল্ট বাঁধতে বাধ্য করবেন। কারণ সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো এবং গাড়িতে চড়া দুটোই নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গাড়ির গতিসীমা
গাড়ি চালানোর সময় কখনই হুটহাট করে গাড়ির গতিসীমা বাড়ানো বা কমানো যাবে না। কারণ হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানো প্রায়শই বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকুন
অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। মনে রাখবেন এটি একটি বিকৃত চিন্তা। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাই ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালাতে হবে।
কথা বলা থেকে বিরত থাকা
গাড়িতে চড়ে অনেক যাত্রীকেই দেখা যায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে দেয়। এটি কোনোভাবেই ঠিক নয়।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি না চালানো
গাড়ি চালানোর সময় চালক নেশাগ্রস্ত থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কখনোই গাড়ি চালাবেন না।
অল্প দক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি না চালানো
অল্প দক্ষ চালক দিয়ে কখনোই গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য। তাই এক্ষেত্রে গাড়ির মালিদের সচেতন হতে হবে।
এমন কোনো দিন নেই, যেদিন দেশের কোনো না কোনো এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মানুষ আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। নিহত ও আহত হওয়া এসব মানুষের কী দুর্দশা, তা কেউ জানে না। ‘একটি দুর্ঘটনা, সারাজীবনের কান্না’ বলে যে কথাটি রয়েছে, তা এসব পরিবারের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বা সংঘটিত দুর্ঘটনায় চালকের তেমন কোনো ত্রুটি ছিল না বলে একটি কথা আছে। তবে আমাদের দেশে প্রতিদিন যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেক্ষেত্রে এ কথাগুলো খাটে না। এসব দুর্ঘটনার সিংহভাগই অদক্ষ চালক, বেপরোয়া যান চালনা এবং সড়কের নিয়ম-নীতি না মানার কারণে ঘটে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনার এসব কারণ নতুন কিছু নয়। বহু আগেই কারণগুলো চিহ্নিত হয়ে আছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এগুলোর প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয় না বা হচ্ছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারে দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। সড়ক অবরোধ করে তাদের সহপাঠীদের হত্যার বিচার চেয়েছে। সরকারের তরফ থেকে সড়ক নিরাপদ ও দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হবে বলা হলেও তার বাস্তব কোনো উদ্যোগ নেই। উল্টো দুর্ঘটনার হার বেড়ে চলেছে। চালকদের বেপরোয়া আচরণও থামছে না।
যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, সেসব পরিবারের ক্ষতি নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। দুর্ঘটনার জন্য তারা যেমন দায়ীদের দায়ী করতে পারছে না, তেমনি তাদের ক্ষতিপূরণও হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া ও অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাদের গ্রেফতার করা হলেও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না। এক্ষেত্রে পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠে। সরকারও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে যে আইন করা হয়, তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
দুর্ঘটনার শিকার যানবাহনের ক্ষতি কত হয়, তা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, এ বিষয়টি সরকার আমলে নিচ্ছে না, শুধু তার লোকজন নীতিনির্ধারণী জায়গায় বসে থাকার কারণে। তা নাহলে, আইন করেও কেন তা কার্যকর হবে না? এখানেই সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে অধিকাংশ চালককে ঘুষ দিয়ে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হতো না। হাইওয়ে পুলিশ যদি¡ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করত তবে, গাড়ি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারত না। মোটরযান আইনে জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার, ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সার্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে শহর ও লোকালয়ে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ৫০ কিলোমিটার। মহাসড়ক ও শহরের যানবাহনের গতির দিকে তাকালে গতিসীমার এ আইন যে কেউ মানছে না বা কর্তব্যরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ মানানোর যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাস-ট্রাকের অনেক চালক বলেছেন, তাদের প্রায় সব চালকই ট্রিপ অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। তারা মাসিক বেতনভুক্ত নন। এজন্য ট্রিপ বাড়ানোর জন্য পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো হয়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ট্রিপ বাড়িয়ে বাড়তি রোজগারের জন্য তারা শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকিই নিচ্ছে না, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাব, মাদকাসক্তি, মোবাইলে কথা বলা, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের ত্রুটি ও যথাযথ সংস্কারের অভাব, আইনের কার্যকর প্রয়োগ না হওয়াÑএসব কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করতে পারলেই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। কাজেই শনাক্তকৃত কারণ দূর করতে এবং পরিবহন খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। মূল সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পরিবহন সংগঠন ও মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্ধারণ, বিআরটিএ’র দক্ষতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন নিষিদ্ধ বা বিকল্প সড়ক নির্মাণ করতে হবে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বা দুটি গাড়ির মালিকদেরসহ অন্যান্য পরিবহন কোম্পানীকে একটি বড় কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশেই মালিকদের সমন্বয়ে বড় কোম্পানি গঠন করে পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। এতে চালক ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সারা দেশের চালকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে চালকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সড়কের নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য চালক ও যাত্রীদের বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশে শতকরা ৭০ ভাগ যাত্রী সড়ক পরিবহনে যাতায়াত করে। সড়ক পরিবহনে এত যাত্রী খুব কম দেশেই দেখা যায়। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহনের উপর থেকে চাপ কমাতে হবে। এজন্য রেল ও নৌপথকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। রেলকে যাত্রীদের কাছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বাংলাদেশে রেলের বিপুল সম্পত্তি ও বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এবং সেবার মান বৃদ্ধি করে যাত্রীদের রেল ভ্রমণে উৎসাহী করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ সবসময়ের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তখনই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে সঠিক তথ্যই নেই। নেই উদ্যোগও। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সরকারি তথ্যের উৎস পুলিশ। সড়ক দুর্ঘটনার পর মামলা হলেই পুলিশ তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। ভুক্তভোগী কেউ মামলা না করলে কিংবা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে ফেললে পুলিশের খাতায় কোনো তথ্য থাকে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত, ধরন ও কারণ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় পরিকল্পনা প্রণয়নে ঘাটতি থেকে যায়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৯৯৭ সাল থেকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করে আসছে। এর মধ্যে সাতটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ পরিকল্পনায় ২০২৪ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসাব প্রকাশ করছে, তাতে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সরকার সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশনটি জানায়, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে উল্লেখ করেছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থার উন্নয়নে সবার সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।
মামুনুর রশীদ নোমানী,
সম্পাদক ও প্রকাশক,
বরিশাল খবর।
সমন্বয়ক,সেভ দ্য রোড,বরিশাল শাখা।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মামুনুর রশীদ নোমানী ।
যোগাযোগ: আদালত পাড়া সদর রোড,বরিশাল। ইমেইল: [email protected] মোবাইল: 01713799669
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2008-2023 BarisalKhabar24.com