মেজভাই কে মনে পড়লে আমার মনে পড়ে, ঝাকড়া লম্বা চুল গোফ দাড়িওয়ালা চটের বস্তা পরা একটা ফকির যে কিনা আমাদের আশ্রম রোডের বাসার গ্যেটে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে মা’কে বলছে, “মা তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি শিবলী।” মা’র পিছনে আমি গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। বিস্মিত ভাবে দেখছি, সদ্য মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফেরত আসা এক গেরিলা যোদ্ধা কে। গল্পে শোনা আমার মেজভাইকে। যে বেঁচে আছে কি নাই সেটা আমরা ১৯৭২ সালের আগে কেউই জানতাম না।
মনে পড়ে গোলাপি ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে তার মেজভাইর পিছু পিছু লাল সুড়কি ঢালা সুরেন্দ্র নাথ রোড দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে পি টি আই স্কুলে ভর্তি হতে।
মনে পড়ে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় সন্ধ্যায় ষষ্ঠী তলা পাড়ার বাসার মাঠে গ্যারেজ করা রিক্সার হাতলে ভর দিয়ে মেজভাইর অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বল প্রিন্টের ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটার কথা।
মনে পড়ে ১৯৮৩ সালে এস এস সি পরীক্ষার আগে টাইফয়েডে আক্রান্ত মেয়েটার মাথার কাছে সারারাত পায়চারি করা চিন্তিত মেজভাইকে।
মনে পড়ে ২০১৯ সালে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত মেজভাই কে নিয়ে আমার দিনরাত ব্যস্ততার তিনমাস।
মনে পড়ে ২০১৯ সালের ঈদের দিন ঢাকায় একসাথে ভাত খাবার সময় বলা সেই কথা, সম্ভবত এটাই তোর সাথে আমার শেষ ঈদ।
মনে পড়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন গুলোতে আমার কাছে তাঁর বেঁচে থাকতে চাওয়ার আকূতির কথা।
মনে পড়ে ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর করুন হাসি যখন আমি চিৎকার করে বলছি এই তো তুই আর কয়েক দিনেই সুস্থ হয়ে যাবি।
মনে পড়ে ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি শেষ দুপুরে আমার কোলে মাথা রেখে করুন চোখে তাকিয়ে যে সিংহ শাবকটি তিনবার হিক্কাযুক্ত আল্লাহ উচ্চারণ করে একমুখ রক্ত তুলে আমাকে ভিজিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে গ্যালো সেই হাড্ডিসার করুন মুখটি।
যার কাছে আমার আমরন ঋণ সে আমার মেজভাই।
আজ শুনি সে নাকি আমার আইনত আপন ভাই নয়।
কিন্তু আমি তো জানি তাঁর সাথে আমার জন্ম- মৃত্যুর বন্ধন। জন্ম মৃত্যুর ঋণ। যা শোধ হবে আমার দেহাবসানের মাঝ দিয়ে….
একই রোগ আমার মাঝে বিস্তার লাভ করায় আশ্চর্যান্বিত হই নি। আমি তো তাঁর মৃত্যুশয্যায় কায়মনোবাক্যে এটাই চেয়েছিলাম – আমাকে নিয়ে আমার মেজভাই কে বাঁচাও।
অপেক্ষায় আছি চলে যাবার। একমাত্র মৃত্যুই হয়তো প্রমাণ করতে পারবে সব বন্ধন রক্তের হওয়ার দরকার হয় না । কিছু বন্ধনের কোন নাম থাকে না। কিছু ঋণ শোধ হয় মৃত্যু দিয়ে ………