এপ্রিলের ঝকঝকে রোদ। প্রচণ্ড গরম পড়েছে ! যথারীতি মাসের প্রথম দিনেই শুরু হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। ভিজিলেন্স টিমের দায়িত্ব পালন করতে পলাশপুর ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজে’ গিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে বেরোবার জন্য গেটের দিকে এগিয়ে আসতেই, চোখ আটকে গেল, শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মায়ের দিকে। মা পুলিশের একজন কনেস্টেবল।কলেজের গেটে ডিউটি করছেন। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢোকার মুহূর্তে লক্ষ্য করিনি। কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল হয়তো শুরু থেকেই ছিলেন।
চকিতে বুকের ডান দিকে নাম ফলক দেখে নিলাম। নাম ‘রুবিনা’। বয়স ২৭-২৮ বছর হবে। বেশ লম্বা,দোহারা গড়ন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ,ডিম্বাকৃতি মুখ। সাদামাটা চেহারা।আরো দুজন পুরুষ কনস্টেবল কাছেই প্লাস্টিকের নীল রঙের চেয়ারে বসে আছেন। শিশুটির বয়স দুই থেকে আড়াই বছর হতে পারে। পরনে হাতা কাটা গেঞ্জি কালো,হলুদ ডোরাকাটা। কালো হাফ প্যান্ট। পা দুটো খোলা। জুতো জোড়া চেয়ারের নিচে রাখা আছে। মায়ের কোলে থেকে থেকে, মোটা কাপড়ের উর্দির সংস্পর্শে গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে ! আর কী যে গরম পড়ছে কদিন ধরে! বেচারি মা ক্ষণেক চেয়ারে বসছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছেন। পিঠে হাত বুলিয়ে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
দুপুরের রোদ ক্রমশ বাড়ছে। কলেজ গেটের দুপাশে হালকা কিছু গাছপালা আছে। তবে গেটের কাছে পাতার ফাঁক গলিয়ে কিছুটা ছায়া থাকলেও রোদ যেন আসর জমিয়েছে ! রুবিনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঠোঁটের নিচে জমে থাকা ঘাম থুতনির কাছে এসে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ। বগলের নিচে ঝরে পরা ঘাম অজানা দেশের মানচিত্র এঁকেছে।উর্দির পিঠের দিকটা একদম ভিজে গেছে।
ছেলেটা মায়ের ঘাড়ের উপর মুখ রেখে তার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। শিক্ষকতা করি, পেশাগত অভ্যেস থেকেই মুখ ফসকে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো,
“একী বাচ্চাটাকে নিয়ে এভাবে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওকে নিয়ে ছায়ায় গিয়ে বসুন।”
রুবিনা কোন কথা না বলে নিরব দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালেন।
বললাম ,” আপনার বাসা কোথায় ?”
রুবিনা হাতের ডান দিকে ইশারা করে বললেন,
” ভাটিখানা।”
এই কলেজ থেকে ভাটিখানা অনেকটাই দূরে। আমি মনে মনে দূরত্বটা ভাবতে লাগলাম।
“বাসায় ওকে রাখার মতো কেউ নেই?”
“না, আমি বরিশালে নতুন এসেছি। এখন পর্যন্ত কাউকে রাখতে পারিনি।”
“আপনার হাজবেন্ড কোথায় আছেন?”
কোন কথা না বলে রুবিনা চোখ নামিয়ে নিলেন। মুখে হঠাৎ ছায়া ঘনিয়ে এলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার প্রশ্নে রুবিনা বিব্রতবোধ করছেন। নিজের উপর আমার রাগ হলো। স্থান কাল পাত্র-বোধ আমার খুবই কম! কথা বলার সুযোগ পেলে বলতেই থাকি। আমার ছেলে,মেয়েরা পর্যন্ত এজন্য আমার উপর রাগ করে।
বাচ্চাটা ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে। বেচারা রোদের তাপে কষ্ট পাচ্ছে খুব!
রুবিনা নিজে থেকেই বললেন ,” এখন ওর ঘুমের সময়, তাই কান্না করছে।”
এক পাশ থেকে লক্ষ্য করলাম রুবিনার চোখের কোণে চিক চিক করছে।
বললাম,”কলেজের ভিতরে একটা জায়গায় ওকে শুইয়ে রাখতে পারতেন। ভিতরে আয়ারা আছেন, তাদের কাউকে বলতে পারতেন দেখে রাখার জন্য।”
মুখে মলিন হাসির রেখা টেনে রুবিনা বললেন,” নতুন জায়গা, লোকজন সব নতুন। আমি কাছে না থাকলে বাবু ভয় পাবে।”
আমার ডায়াবেটিস। মাঝে মাঝেই সুগার ফল করে, তাই ভ্যানিটি ব্যাগে চকোলেট রাখি। ইচ্ছে হলো বের করে বাবুটার হাতে দিই। কিন্তু না,পরক্ষণেই ভাবলাম আমি অচেনা মানুষ, আমার দেওয়া চকোলেট রুবিনা নাও নিতে পারেন।
পাঁচ মিনিটের ঘণ্টা পড়েছে। একটু পরেই পরীক্ষা শেষ হবে। রাস্তার ওপারে অভিভাবকরা অনেকেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। ঘণ্টা শুনে তারা যেন একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। আমি যখন ক্যাম্পাসে ঢুকেছি, তখন অভিভাবকদের সংখ্যা এখনকার চেয়ে কম ছিল। হয়তো পরীক্ষা শেষ হবার সময় ঘনিয়ে আসছে বলেই তাদের উপস্থিতি বেড়েছে। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা চলছে। আবশ্যিক বিষয়। কেন্দ্রের সবকটা কক্ষে পরীক্ষা চলছে।
বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন মহিলাকে দেখলাম দোকানের পাশে গলির মুখে পত্রিকা বিছিয়ে বসে আছেন। ছোট হাতপাখা নাড়িয়ে গরম তাড়ানোর চেষ্টা করছেন কেউ। বোরকা পরা একজন কৌটা খুলে পানের খিলি বের করে পাশের জনকে দিয়ে নিজের মুখে পুরলেন একটা। পিচ করে পিক ফেললেন তিনি।কেউ কেউ আবার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। চায়ের দোকানে বসে জটলা করছেন কয়েকজন।এরা সম্ভবত ছাত্রীদের অভিভাবক। অল্প বয়সী এক তরুণ সাইকেলের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ কলেজের দিকে। কয়েকটি রিক্সা এবং অটোরিক্সা রাস্তার ওপারে পার্ক করা আছে।এরা হয়তো পরীক্ষার্থী নিয়ে রিজার্ভে যাবেন।একটু দূরে একটি তরুণী মোবাইল ফোনে হেসে হেসে কথা বলছে। রিক্সা, অটোরিক্সা, সিএনজি আসছে যাচ্ছে। পথচারীরা কেউ ব্যস্তভাবে , কেউ আবার মৃদুমন্দ গতিতে আসা-যাওয়া করছেন। মাথায় টুপি পরা তিনজন পুরুষ কাছেই কলেজের মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যোহরের আজানের সময় হয়ে এসেছে।
রুবিনার বন্দুক গাছের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে মা পায়চারি করছেন। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা ! চোখের পাতার নিচে কান্নাভেজা দাগ । একটু আগের ছটফটানি হঠাৎ থেমে গেছে। ইচ্ছে হলো মোবাইলে মা ও ছেলের একটা ছবি তুলে রাখি। কিন্তু সেটা উচিত নয়। বাঁ হাতে ঘড়ির দিকে তাকালাম। শেষ ঘণ্টা পড়ার মিনিট খানেক বাকি আছে। সবাই বের হয়ে এলে যানবাহনে জায়গা পাওয়া কঠিন হবে। তাই আর দেরি করা ঠিক হবে না। দ্রুত পা চালিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে, রাস্তার ওপারে গিয়ে হাতের ইশারায় একটা অটোরিক্সা থামিয়ে উঠে পড়লাম। মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসলো।ভর দুপুরের ঝাঁঝালো রোদ আর ব্যস্ত পথের কোলাহল ছাপিয়ে মহিমাময়ের শ্রেষ্ঠত্ব ছড়িয়ে পড়ছে ইথারে। অটো স্টার্ট দিতেই ঘাড় ঘুরিয়ে কলেজের গেটের ভিতরে তাকালাম, ঝাপসা হয়ে আসছে সব! রুবিনা ও তার ছেলেকে আর দেখা যাচ্ছে না।
১৩.১১.২২
বরিশাল।