মানবতার জয় হোক
-মাহবুবা ফারুক
আমার দাদা রবিউল্লাহ ও কবি রবীন্দ্রনাথ দুজনেই চলে গেছে মানুষের জীবন পাড়ি দিয়ে
কোনো পার্থক্য বোঝা গেল না
আরো আছে তুহিন কাজল সজল উর্মি কমল নীরা শান্তি সীমা শোভন ধ্রুব সান্ত্বনা চন্দনা বেবী বিউটি প্রীতি ছবি মুন্নী চঞ্চল নামগুলো থেকে কি বোঝা গেল?
মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ?
কিন্তু এগুলো মানুষের নাম এটা তো বুঝা গেল ? এটুকু বুঝলেই ভালো
এমন অনেক অনেক নাম আমার পরিবারের আর আশেপাশে প্রতিবেশী আপনজনদের
যাদের সাথে বেড়ে উঠেছি ভালোবাসা মায়া মমতায়
এক মাঠে খেলা করেছি এক স্কুলে পড়েছি
স্কুলটি কৃষ্ণ প্রসাদের দান- স্থানীয় জমিদার ছিলেন তিনি
সেখানে হিন্দু মুসলমান সবাই লেখাপড়া করে
জমিদার বাড়ির মেয়েদের সাথে আমার মা খালাদের ছিল বন্ধুত্ব ছিল একসাথে খাওয়া বসা
পঙ্কজ গুণ ও বাসনা গুণ ভালোবাসায় হয়ে উঠেছিলেন আমার মামা মামী
আমার মা তার বড় ভাইকে ডাকতেন ‘দাদা’
আমার ভাইবোনেরা বড় ভাইদের ডাকে ‘দাদা’
আমার স্বামী তার বাবা-মাকে ডাকে ‘বাবা’ ও ‘মা’
আমার হিন্দু বন্ধুদের সাথে ডাকগুলোর কোন তফাৎ নেই
যখন আযান হয় তখন পূজোর ঘন্টা বাজে না
পুজো, মেলা,বিয়ে অথবা ঈদের সময় আমরা বন্ধুরা একসাথে আনন্দ করি
দুর্গাপুজোয় আরতি ও বিসর্জন দেখতে যেতাম
হিন্দুরা আমাদের বাড়িতে ঈদের নিমন্ত্রণ পেয়ে আসতো
নলিনী বাবু , চিনি গুণ বাবু, জগদীশ বাবু,বীরেন্দ্র বাবু,শ্যামল স্যার, নীলিমা দি ,রেখা দি
আমাকে পড়িয়েছেন কত না যত্ন করে
কোন তফাৎ দেখিনি ধর্মের।
রাতবিরেতে অসুখ হলে ছুটে আসতেন নারায়ণ মামা, ননী দা,
আর ছোটবেলায় আমার যখন হাম হয়েছিল সবটুকু চেষ্টা দিয়ে চিকিৎসা করেছেন রাধা ঠাকুর,
ডোবার পানিতে পচা কচুরিপানায় ডুবে যাচ্ছিলাম
চিৎকার শুনে কোলে তুলে নিয়ে এসেছিলেন ললিত মামা
আমাদের পুকুরে মাছ ধরে দিয়ে যেত কানু দা
বাঁশ কেটে আমাদের বাগানগুলোতে বেড়া দিতো ধরণী মামা, সুধীর দা,
আমাকে বানিয়ে দিতো তীর ধনুক
ঘরের অনেক কাজে সাহায্য করতেন সিধু মাসি ।
অধীর দাদার দোকানের মিষ্টি আমাদের আজও আড্ডার প্রধান আকর্ষণ
হরেন্দ্র মামার দোকান থেকে পুতুলের কাপড় আনতাম
আজও কানে ভেসে আসে তার সেলাই মেশিনের শব্দ
আমাদের ভাই-বোনদের চুল কেটে দিতেন সঞ্জয় দা
বেলাদি’র বাবা জীবন মিস্ত্রিকে মামা বলতাম
হিন্দু-মুসলমান অনেকেই আমার নানাভাইকে ‘আব্বা’ ডাকতো
কী অসাধারণ ছিল প্রতিবেশীদের সহমর্মিতা !
ঝরনার বিয়েতে সারারাত আমরা কত মজাই না করেছিলাম!
সেই দিনগুলো কি করে ভুলবো?
ঈদ,পূজা, পয়লা বৈশাখে বারহাট্টা থেকে বিপ্লবের ফোন আসে না এমন তো কখনো হয়না
অনেকদিন দেখা না হলে রণবীর ফোন করে জিজ্ঞেস করে, আপা কেমন আছো?
জিতু কাকা গনেশ কাকা মন্তোষ কাকা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন
আব্বার পছন্দ ছিল শরত পালের মুদির দোকান
মুনিয়ার বাদাম না কিনলে আমার দিন কাটতো না
জয়রামের মায়ের হাতে জন্ম হয়েছে এলাকার অনেকের
টুনু মুচি আর ধোপা বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়তো আমাদের স্কুলে
শ্যামলাল,লসপানিয়া ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতো অফিস, বাজার, হাসপাতাল হাসিমুখে
ঝুলনদের পূজার বাসন ধুয়ে দিয়েছি কতদিন!
তখন ভাবতাম না আমাদের কি ধর্ম
শুধু জানতাম এরা আমাদের অনেক আপন জন আজও সেভাবেই আমরা বন্ধুরা একখানে হলেই সব
ভুলে আমরা শুধু মানুষ হয়ে ওঠি
আবার যখন দেখা হবে শান্তি দি ঝরনা দেবীর সাথে
আমরা সবাই শুধু বন্ধু হয়ে উঠতে চাই
আমাদের এই সম্প্রীতি চিরদিন জেগে থাক অন্তরে অন্তরে
এসো আমরা সবাই ভালোবেসে বেসে থাকি।
লেখক:
মাহবুবা ফারুক,
জন্ম নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টায়।
পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত বইয়ের নাম, শিশুতোষ- প্রজাপতি, ভূতের বাড়ি কয়েকদিন, মা পাখি বাচ্চা পাখি, বাচ্চা পাখি ফিরে এলো মা পাখিটার কাছে, বনে এক বাঘ ছিল, পরিবিবির সাথে দেখা হয়েছিল, ভূতের বংশধর প্রভৃতি। এছাড়া আছে কবিতার বই- শুক্লা দ্বাদশী ও টুকরো করলে নেবো না আকাশ, বদলে যাওয়া দৃশ্যগুলো। ছোটবেলায় স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখির শুরু। প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল ‘বেগম’ পত্রিকায়। বিটিভির তিনি তালিকাভূক্ত গীতিকার । বিটিভিতে প্রচার হয়েছে তাঁর লেখা নাটক।