বরিশালের নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিদর্শনের মধ্যে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী দূর্গা সাগর অন্যতম। এ দীঘি দেখতে দেশ বিদেশ থেকে শতাধিক মানুষের সমাগম হয় প্রতিদিন।
বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশায় স্থানীয় জনগণের পানি সঙ্কট নিরসনে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দীঘিটি খনন করেন চন্দ্রদ্বীপের পরগনার তৎকালীন রাজা শিব নারায়ন। স্ত্রী রানী দূর্গাবতী একবারে যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততদূর পর্যন্ত এ দীঘি খনন করা হয় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে। আর রানী দূর্গাবতীর নামেই দিঘীটির নামকরণ করা হয় দূর্গা সাগর। দিঘী খননে এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর চার শতাংশ পাড়। এছাড়া দীঘির চারপাশ দিয়ে ১.৬ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা রয়েছে। পাড়টি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৪৯০ ফুট এবং প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। দীঘিটির মাঝখানেই রয়েছে ছোট্র একটি দ্বীপ। যা এ দীঘির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দীঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জেলা বোর্ড এটি সংস্কার করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৪ সালে দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। তখনকার জেলা বোর্ড ১২০০ টাকা ব্যয় করে দিঘীটি পরিষ্কার করে। সে সময়েই দীঘির মাঝামাঝি স্থানে অবকাশ যাপন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ছোট দ্বীপের ন্যায় তৈরি করা হয়। দীঘির চারপাশে নারিকেল, সুপারি, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি বৃক্ষ রোপন করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। যা বর্তমানে দীঘিটির শোভা বর্ধন করেছে। দীঘির চারপাশে বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিনোদনের নতুন মাত্রা খুঁজে পায় প্রকৃতিপ্রেমীরা। আর চিরচেনা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে এ দীঘি যেন গ্রামীণ নিঃসর্গে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।
মধ্যখানে দ্বীপবিশিষ্ট এ দীঘির সর্বশেষ ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সংস্কার করা হয়। দীঘির চার পাশে চারটি সুদৃশ্য বাঁধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব দক্ষিণ পাশের ঘাট দুটি বিলীন হয়ে গেছে।
পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। ইচ্ছা করলে ভ্রমণকারীরা এখানে রাত কাটাতে পারেন।
দীঘির পশ্চিমে শ্রীপুর, পূর্বে কলাডেমা, উত্তরে পাংশা এবং দক্ষিণে শোলনা ও ফুলতলা গ্রাম। চার গ্রামের মধ্যস্থানে এক শুভদিনে হাজার হাজার লোক দীঘি খনন কাজ শুরু করেন। চন্দ্র দ্বীপ রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম হতে প্রজারা দীঘি খননে অংশ নেয়। দীঘি খনন কাজ শেষ করতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগে। সারাদিন কাজ করে শ্রমিকরা পশ্চিম পাশে একটি দীঘিতে মাটি কাটার যন্ত্র ধুতেন। এ দীঘির নাম দেয়া হয় কোদাল দীঘি। দীঘি খনন ও অর্চনার জন্য রাণী রাজকোষ হতে তিন লাখ টাকা ব্যয় করেন। চারপাশে পঞ্চাশ ফুট বিস্তৃত চারটি পাকা ঘাট নির্মাণ করেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি উৎপাদনমুখী হওয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে বরিশালের দূর্গাসাগর পাড়ের বাগানে বিচরণ করছে তিনটি হরিণ। এমনটাই জানিয়েছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান।
তিনি জানান, দিঘীর দ্বীপটিকে আকর্ষণীয় করতে সেখানে রাখা হয়েছে কৃত্রিম বাঘ। এছাড়া পর্যটকদের বিনোদনে দিঘীতে চলাচল করছে নৌকাও।
দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত দূর্গাসাগর দীঘিতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। ২০১৬ সালে এটিকে দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটক নির্ভর করার লক্ষ্যে মাঠে নামে জেলা প্রশাসন। যাতে সফল প্রাপ্তিও ঘটে বলে জানান জেলা প্রশাসক ।
রাণী দুর্গাবতী বুদ্ধিমতি ও প্রজাবৎসল ছিলেন। আঠার শতকের শেষভাগে নাটোরের রাণী ভবানী ও চন্দ দ্বীপের রাণী দুর্গাবতী জমিদারী পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।