বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডে বৃক্ষ রোপনে “শুভঙ্করের ফাঁকি”
প্রকাশ: ২৪ মার্চ, ২০২৩, ২:০৪ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বরগুনা প্রতিনিধি:
বরগুনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে উপকূলের রক্ষাকবচ বেরিবাঁধ সুরক্ষায় তিন কোটি টাকার বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফলজ, বনজ ও ওষধিসহ বিভিন্ন প্রজাতীর ৮৮ হাজার বৃক্ষ রোপন করার কথা থাকলেও নামমাত্র গাছ লাগিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ খোদ অফিস কর্মকর্তাদের যোগশাযোশেই বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিতে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস সংশ্লিষ্টদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনা কার্যালয় সুত্রে জানাগেছে, বরগুনার ৬টি উপজেলার ২২ টি পোল্ডারের অধিনে বেরিবাঁধ রয়েছে ৮০৫ কিলোমিটার। ঝড়, জলোচ্ছাস ও বিভিন্ন দুর্যোগের হাত থেকে উপকূলের রক্ষাকবচ এই বেরিবাঁধ সুরক্ষিত করার জন্য তিনটি কার্যাদেশের মাধ্যমে প্রায় তিন কোটি টাকার বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচির অধিনে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বার্ষিক মেরামত খাতের অর্থে বরগুনার ৬টি উপজেলায় ৮৮ হাজার বৃক্ষ রোপন করা হয়। তিনটি কার্যাদেশে বৃক্ষ রোপনের জন্য ব্যায় নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। বৃক্ষ রোপনের পাশাপাশি ৬ মাসের পরিচর্যারও দায়িত্ব দেওয়া হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বৃক্ষ রোপনের জন্য দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে এ কাজ বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এরমধ্যে নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ২টি ও বকশি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ১টি কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী মেহগনি, টিক, শাল, চাম্বল, আম, কাঠাল, লিচুও কুল গাছ লাগানোর কথা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত কাগজ কলমের তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী দেখা গেছে বরগুনার ৬টি উপজেলার সবকটিতেই কমবেশি বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রয়েছে এর ভিন্ন রুপ। কয়েকটি পোল্ডারে নামমাত্র গাছ লাগানো হলেও অধিকাংশ পোল্ডারেই কোন গাছ লাগানো হয়নি। যেসকল পোল্ডারে গাছ লাগানো হয়েছে সেগুলোও পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ বৃক্ষরোপনের কার্যাদেশ অনুযায়ী বৃক্ষ রোপনের সাথে ৬ মাসের পরিচর্যাও অন্তর্ভুক্ত করা ছিলো। পোল্ডার ভিত্তিক গাছ লাগানোর কথা থাকলেও কোন পোল্ডারে কতো গাছ লাগাবে সেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। তাই কর্মকর্তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়েই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়েছে এই বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনে বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ না করেই টেন্ডার ছাড়াই প্রায় তিন কোটি টাকার বৃক্ষরোপনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলমরে পছন্দসই ঠিকাদার প্রকৌশলী মাইনুদ্দিন আসাদ নামের এক ব্যক্তিকে। কাজ প্রায় শেষের পথে বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হলে এই কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডারে নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেড ও বকশি এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই কাজ পায়। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ঠিকাদার মাইনুদ্দিন আসাদের সাথে পরামর্শ করেই এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দুটোকে টেন্ডার দাখিল করতে বলা হয়। টেন্ডার অনুযায়ী বৃক্ষরোপন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হলেও এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ছিলো না বৃক্ষরোপনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা। অথচ ভ‚য়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে কাজ বাগিয়ে নেন তারা। প্রশ্ন উঠেছে টেন্ডার প্রক্রিয়া হওয়ার আগেই কি করে ঠিকাদার মাইনুদ্দিন আসাদ ও নির্বাহী প্রকৌশলী বুঝতে পারলেন এই দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই কাজ পাবেন এবং সেই কাজ মাইনুদ্দিন আসাদকে দিয়েই বাস্তবায়ন করা হবে। অভিযোগ উঠেছে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম, ভারপ্রাপ্ত উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী বিপন সাহা, উপ সহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম সোহাগ ও বরগুনার স্থানীয় ঠিকাদার প্রকৌশলী মাইনুদ্দিন আসাদসহ কাজ পাওয়া দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের যোগশাযোশে এই কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রত্যক্ষ মদদে কিছু কিছু পোল্ডারে নাম মাত্র গাছ লাগিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও একই সময় উপক‚লীয় বেরিবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বরগুনা সদর উপজেলা ও পাথরঘাটা উপজেলায় ১ লাখ ৫০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতীর বৃক্ষ রোপন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলীর তক্তাবধায়নে এই প্রকল্পের গাছের ছবি দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়।
কার্যাদেশ অনুযায়ী ৮৮ হাজার গাছ লাগাতে ব্যায় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৬৪ হাজার ৫৪৫ টাকা। এতে প্রতিটি গাছের পিছনে ব্যায় ধরা হয়েছে ৩২২ টাকার কিছু বেশি। বর্তমান বাজার মূল্য যাচাই করে দেখাগেছে যে সকল গাছ লাগানো হয়েছে রোপন উপযোগী এই সকল গাছ প্রতি ৫০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ বাজার দরে বিক্রি করা হচ্ছে বরগুনার হাট বাজার গুলোতে। বাজার দরের সর্বোচ্চ দাম ১২০ টাকা অনুযায়ী গাছের মূল্য দাড়ায় ১ কোটি ৫৬ হাজার টাকা। বৃক্ষ রোপন ও পরিবহন ব্যায় বাদ এসব গাছ লাগাতে আরো অর্ধকোটি টাকা ব্যায় হলেও বাকি টাকা কোথায় গেলো? অভিযোগ রয়েছে বাকি টাকা প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
সরেজমিনে বরগুনার সকল পোল্ডার ঘুরে দেখা গেছে, বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের দুটি বেরিবাঁধে গাছের দৃশ্যমান অস্তিত্ব রয়েছে। বাকি পোল্ডারগুলোতে কোন গাছে অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অনেক পোল্ডারে কোন গাছ লাগানোই হয় নাই বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কিছু কিছু পোল্ডারে গাছ লাগানো হলেও পরিচর্যার অভাবে তা নষ্ট হয়ে গেছে। বরগুনা সদর উপজেলার গোলবুনিয়া খেয়াঘাটের দক্ষিণপাশের বেরিবাঁধে গাছ লাগানোর কথা থাকলেও বেরিবাঁধটিতে গিয়ে কোন গাছ পাওয়া যায়নি। তালতলী উপজেলার বগী খেয়াঘাটে গাছ লাগানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঠিকাদার। কিন্তু বাস্তবে সেখানে গিয়ে কোন গাছ পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে কিছু গাছ লাগালেও পরিচর্যার অভাবে তা নষ্ট হয়ে গেছে।
সদর উপজেলার গোলবুনিয়া খেয়াঘাটের দক্ষিন পাশের বাসিন্দা জয়নাল, আবুল, কাশেম, ছগির সহ স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, পায়রা নদীর ভাঙনে আমরা দিশেহারা। প্রতিবছর ভাঙনের কবলে আমার সবকিছু হারাতে হয়। বেরিবাঁধ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু শুনেছি সেই বেরিবাঁধ সুরক্ষার জন্য গাছ লাগানো হয়েছে কিন্তু আমরা চোখে কোন গাছ দেখিনি। গাছগুলো আমাদের এখানে লাগিয়ে যদি আমাদের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব দেওয়া হতো তাহলে আমাদের প্রয়োজনেই আমরা গাছগুলো রক্ষার উদ্যোগ নিতাম।
এবিষয়ে কাগজে কলমে বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেড ও বকশি এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা এবিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে বরগুনার এদের পক্ষ হয়ে কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার প্রকৌশলী মাইনুদ্দিন আসাদ বলেন, প্রাক্কলন অনুযায়ী যেখানে যেখানে গাছ লাগানোর কথা সব জায়গাতেই আমরা গাছ লাগিয়েছি। পরে গাছ নষ্ট হয়ে গেলে কিংবা কেউ নিয়ে গেলে সে দায়ভার তো আমাদের না। অন্যের লাইসেন্সে পাওয়া কাজ কিভাবে আপনি বাস্তবায়ন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিকাদারী করতে গেলে একজন ঠিকাদারের সাথে অন্য আরেকজন ঠিকাদারের ভালো সম্পর্ক থাকে সেই সম্পর্কের জায়গা থেকেই আমি তাদের লাইসেন্স সংগ্রহ করে এখানে টেন্ডার ড্রপ করি। টেন্ডার হওয়ার আগেই অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ করে ফেলেছিলেন আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন কাজ আপনিই পাবেন এমনটা জানতে চাইলে তিনি জানান, এই টেন্ডারে অন্য কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহন করেছিলো কি না আমার জানা নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপর মহল থেকে গাছ লাগানোর জন্য চাপ আসায় তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আমাকে গাছ লাগানোর জন্য বললে আমি লাগিয়ে দেই।
তদারকির দায়িত্বে ছিলেন উপ সহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম সোহাগ তিনি বলেন, আমি এবিষয়ে কোন কথা বলতে পারবো না। এর জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী মহোদয় আছেন তিনি কথা বলবেন। আমি একটি পোল্ডারের দায়িত্বে ছিলাম সেখানে ঠিকঠাক গাছ লাগানো হয়েছে। বাকিদের খবর আমি জানি না।
এবিষয়ে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী বিপন সাহার মুঠোফোনে একাধিকবার সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বৃক্ষরোপনের নামে যেটি করা হয়েছে সেটি পুকুরচুরি। জনগনের টাকায় গাছ লাগিয়ে শুভঙ্করের ফাকি দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগশাযোশেই এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি থাকবে বিকেডা বিষয়টি তদন্ত করে এহেন দুর্নীতির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। তা না হলে ক্রমাগত আরো দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে।
এবিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনা কার্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এবিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালী সার্কেলের তক্তাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। এবিষয়ে যদি কোন অনিয়ম হয়ে থাকে সেবিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।