সঞ্জিব দাস, গলাচিপা, পটুয়াখালী
গোধুলির শেষ লগ্নের লালবর্ণ আকাশ যেমন পাল্টে দেয় সন্ধ্যা তাঁরায়। একইভাবে কৃত্রিম আলোর পশরায় এক নিপুন সন্ধ্যা নেমে আসে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। সন্ধ্যা হলে শত প্রদীপের আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে বুড়াগৌরঙ্গ নদীর তীর। ক্লান্তি চোখ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে নদীর পাড়ের দিঘল এই আলোর পশরায়। সভ্যতা থেকে ছিটকে পরা এই দারিদ্র জনগোষ্ঠির নাম মান্তা সম্প্রদায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ এই পরিবারগুলো এখন বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ন এলাকায় বসবাস করছেন। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও অন্যদের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম এই জনগোষ্ঠি।
সর্বহারা কিংবা নিঃস্ব বলে সমাজে আখ্যায়িত হলেও-নিজেদের মান্তা জনগোষ্ঠি বলে দাবী করেন তারা। বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেষা চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর তীরে এই দারিদ্র জনগোষ্ঠির বসবাস। কখন কোন ঋতু কিংবা বর্ষা মৌসুম-এমন হিসাব-নিকাশ নাই পরিবারগুলোর। কাঠের তৈরী ছোট্ট একটি নৌকা নিয়ে স্থানীয় নদ-নদী গুলোতে মাছ শিকার করাই এদের মুল লক্ষ্য। নৌকায় শুধু মাছ ধরা নয়, নৌকায় জন্ম, নৌকায় শৈশব আর নৌকায় এদের মৃত্যুু হয়। পরিবারের সবাই মিলে নৌকায় বসবাস করে আসছেন জন্ম থেকে।
সারাদিন রোদে পুরে অথবা বর্ষায় কাক ভেজা দিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে। দিনভরের রোজগার দিয়ে সন্ধ্যায় চুলা জালায় নৌকার ছাউনিতে। রাতেই হয় ভোজন। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে শতাধিক মান্তা পরিবার।
এদের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নাই স্বাস্থ্য সেবা অথবা পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জানে না তারা। রোগ-বালাই সারতে দৌড়ে যায় স্থানীয় কবিরাজ, বৈদ্যের কাছে। জন্ম সুত্রে বাংলাদেশী অথবা মুসলীম দাবী করলেও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি থেকে রয়েছে তাদের প্রতি চরম অবহেলা। গ্রাম পর্যায়ে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সাহায্য দেয়া হলেও স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা ভূমিহীন অথবা নদীতে বসবাস কারীদের জন্য কোনো সাহায্য দেয়া হয় না, তাড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ তাদের।
শিক্ষা বলতে বাবা-মায়ের সাথে শিশু-কিশোরদের মাছ ধরা অথবা মাছ ধরার কাজে সাহায্য করা। তিন পুত্র সন্তানের জননী পান্তা জনগোষ্ঠি পরিবারের সদস্য আলেয়া বেগমের সাথে। তিনি বলেন, পটুয়াখালী জেলার কালাইয়া বন্দরের আদিবাসী ছিলেন। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে শত বছর আগে তার পূর্ব পুরুষ চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে ঘাটি বাধে। তারপর থেকেই এই নদীর কিনারে তাদের বসবাস। বাবা রুবেল ও মা আম্বিয়া অনেক আগেই মারা গেছেন। সাগরের নোনা জল যেমন জীবন বাচায়, তেমনি সাগরের এক-একটি ঢেউয়ের সাথে ক্ষয়ে যায় তাদের ছোট-ছোট স্বপ্ন। শিশু দুই সন্তানও তাদের সাথে মাছ ধরার কাজে সাহায্য করছেন। দিনরাত মাছ ধরে বাজারে বেচে দিয়ে সওদা করতে হবে, এমন চিন্তা ছারা সমাজের নূন্যতম সভ্যতা-আচার জানে না তারা।
মান্তা সম্প্রদায়ের সদস্য লিটন জানান, বরশি দিয়ে মাছ ধরেন তিনি। ছয় সন্তান নিয়ে ছোট্ট একটি নৌকার ছাউনিতে সকলের বসবাস। অর্থ সঙ্কটে জাল কেনা হয়নি তার। কিন্তু পরিবারের সদস্য সাত জন। তারা দাবি করেন সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোন আর্থিক সাহায্য এখন পযন্ত তাদের কাছে আসে নাই সরকার যেন তাদের দিকে একটু সু-দৃষ্টি কামনা করেন এই অসহায় মানুষগুলো। এভাবেই বুড়াগৌরঙ্গ নদীর কিনারে শতাধিক নৌকায় নারী-পুরুষ, শিশুসহ চার শতাধিক মানুষের বসবাস।