* রয়েছেন ইউএনও, একাধিক এমবিবিএস চিকিৎসক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ১০ জন প্রধান শিক্ষক নানা স্তরে অর্ধশতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি * শতভাগ পরিবারে উচ্চশিক্ষিত রয়েছে * গ্রামের ৪৭টি পরিবারে লোকসংখ্যা প্রায় আড়াইশ * বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অন্যতম উদাহরণ হতে পারে * গ্রামটি আজও দুর্গম, যাতায়াতব্যবস্থা অবহেলিত
একটি পাঠশালাকে ঘিরে নতুন পরিচয় পেয়েছে ‘পিরেরাবাদ’ নামের একটি গ্রাম। বর্তমানে ৪৭টি পরিবার রয়েছে সেই গ্রামে। লোকসংখ্যা প্রায় আড়াইশ। তাদের মধ্যে একজন ইউএনও, একাধিক এমবিবিএস চিকিৎসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ১০ জন প্রধানশিক্ষকসহ প্রশাসনে ও সমাজ বিনির্মাণে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
তারা সবাই সেই পাঠশালায় লেখাপড়া করেছেন। একে ঘিরে গ্রামের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা ইউনিয়নের অবহেলিত প্রত্যন্ত পিরেরাবাদ গ্রামে ওই পাঠশালার অবস্থান, নাম ‘পিরেরাবাদ পাঠশালা। ’ এটা হতে পারে বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অন্যতম উদাহরণ, একটি আদর্শ গ্রামের নমুনা।
যে পাঠশালার শিক্ষক বা পণ্ডিতের মাসিক বেতন জোগাতে গৃহের প্রতিবেলার রান্না হতে এক মুঠো করে চাল জমা করতে হতো, সেই পাঠশালার অর্ধশতাধিক সন্তান প্রশাসনে কাজ করছেন, সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসীন হয়েছেন। লেখাপড়ার তাগিদে একটি পাঠশালার জন্য যে গ্রামের মানুষেরা জীবনপণ করেছিলেন ৮৫ বছর আগে।
এই পিরেরাবাদ পাঠশালার প্রাক্তন ছাত্র সিলেট সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ শিক্ষাবিদ অনিল কৃষ্ণ মজুমদার এবং গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও টুঙ্গিপাড়া আইএইচটির অধ্যক্ষ ডা. অনুপ কুমার মজুমদার জানান, ১৯৩৭ সালে পিরেরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ‘বীর’ খ্যাত শরৎ চন্দ্র মজুমদার এই পাঠশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটা করতে গিয়ে প্রতিবেশী পাঙ্গাশিয়া গ্রামের সাথে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। পাঙ্গাশিয়া গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামে পাঠশালার ঘর তৈরির চেষ্টা করেন। গ্রামের সেই ‘বীরের’ নেতৃত্বে পীরেরাবাদ প্রতিবেশী পাঙ্গাশিয়ার সশস্ত্র গ্রামবাসীকে প্রতিহত করেন। তখন শরৎ বাবু ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে জীবন দেবো, তবু গ্রামের পাঠশালার ঘর দেব। গ্রামকে শিক্ষিত করতে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠার জন্য এমন ভূমিকা খুবই বিরল। তাঁদের সেই পাঠশালার কারণে আজ আমরা প্রত্যন্ত গ্রাম হতে এখন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। এই পাঠশালায় যাদের লেখাপড়ার ভিত তৈরি হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে একাধিক এমবিবিএস চিকিৎসক, একজন ইউএনও, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ১০ জন প্রধানশিক্ষক, একাধিক সহকারী শিক্ষক, প্রকৌশলী হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোকিত ভূমিকা রাখছেন।
পিরেরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা, পিরেরাবাদ পাঠশালায় যাঁদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়েছিল- প্রশাসন ও সমাজের সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) গ্রামের সেই প্রিয় পাঠশালাচত্বরে মিলিত হয়েছিলেন। তাঁরা গ্রামের প্রয়াত একজন দাইমা-সহ (গ্রামের যে নারী সন্তান প্রসবকালে ভূমিকা রাখতেন) চিতলমারীতে শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ১৬ গুণীজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা ও সম্মাননা দিয়েছেন। এসময় ‘আলোর দিশারী’ নামে একটি স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
যাঁরা সম্মাননা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন পিরেরাবাদ পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র মজুমদার, শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ মালিখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার, মুক্ত বাংলা চারিপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক রসময় বিশ্বাস, বোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহ-প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় মনিমোহন মজুমদার, সমাজ ও সম্প্রীতি উন্নয়নে অবদানে স্বর্গীয় মনোহর রায়, শুকলাল বৈদ্য, রমনী রঞ্জন বিশ্বাস কান্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা হরেন্দ্র নাথ মন্ডল, স্বর্গীয় কালিদাস মন্ডল, মানবসেবিকা চমৎকার বাড়ৈ চোমর, গর্বিত মাতা মালঞ্চ মজুমদার, সাদা মনের সজ্জন জিতেন্দ্রনাথ বেপারী, স্বর্গীয় রমেশ তরফদার, নিবেদিত শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় যোগেশ চন্দ্র বিশ্বাস, উদার ও মুক্তধারার ব্যক্তিত্ব কালশিরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক কাজী সোহরাব হোসেন এবং প্রতিবেশী হিতাকাঙ্ক্ষী স্বর্গীয় শান্তি রঞ্জন মন্ডল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চিতলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অশোক কুমার বড়াল, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী কর্মকর্তা সাইয়েদা ফয়জুন্নেসা, হিজলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী আবু শাহীন। এতে সভাপতিত্ব করেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ শিক্ষাবিদ অনিল কৃষ্ণ মজুমদার।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন পিরেরাবাদ পাঠশালার প্রাক্তন ছাত্র ও গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং টুঙ্গিপাড়া আইএইচটি এর অধ্যক্ষ ডা. অনুপ কুমার মজুমদার। সদস্য সচিব ছিলেন পাঠশালার প্রাক্তন ছাত্রী ও সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস। প্রকাশনা পরিষদের সম্পাদনায় ছিলেন খুলনার রূপসা উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার নিত্যানন্দ মন্ডল।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, গৃহস্থের মুঠো মুঠো চালে যে পাঠশালার পণ্ডতের বেতন যোগাতে হতো, সেখানের অর্ধশতাধিক সন্তান প্রশাসনে ও সমাজে ভূমিকা রাখছেন। এটা দেখে শেখার আছে। এই গ্রাম হতে পারে বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে আদর্শ গ্রাম। তারা আরো বলেন, নতুন প্রজন্ম মোবাইল ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের স্কুলগামী করতে হবে। এই প্রজন্ম শিক্ষাবিমুখ হলে ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। অথচ এই গ্রামে যাতায়াতব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ভাঙাচোরা ইট বিছানো মাটির রাস্তা। কবে কতদিন আগে এই রাস্তায় ইট বিছানো হয়েছিল নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। এক পশলা বৃষ্টি হোক বা না হোক- গ্রামের এই রাস্তায় চলাচল করা রীতিমতো ভোগান্তি।