করোনার প্রকোপ আবার বাড়ছে। সরকারীভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে সতর্কতার কোন বিকল্প নেই। আর বেঁচে থাকা মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আর্থিক সচ্ছলতা বা নিরাপত্তা। এজন্য আর্থিক সচ্ছলতার জন্য আমাদের সঞ্চয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে, যেন দরকারের সময় কিংবা খারাপ সময়ে সেই সঞ্চয় দিয়ে উতরে যাওয়া সম্ভব হয়।
প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সাবিনা বেগম মানুষের বাড়ি বাড়ি ছোটা বুয়ার কাজ করে। মধ্য বয়সী এই নারীর স্বামী রিক্সা চালায়। সাবিনা যে বাসায় কাজ করত, সে বাড়ির গৃহকর্ত্রী সাবিনাকে ব্যাংকে ডিপিএস খোলার পরামর্শ দিল। এতে করে কিছু টাকা ব্যাংকে জমা হবে। পরে একটা কাজে আসবে। সে সময় যারা কিছুটা বোঝে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের দিকে, সবাই ডিপিএস খোলার জন্য ব্যাংকের কাউন্টারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। বলা যায়, ডিপিএস খোলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যখানে। সাবিনা কিংবা তার স্বামী শুধু নাম লিখতে পারত। আর কিছুই জানত না। যাই হোক, সেই বাড়ির গৃহকর্তা সাবিনার স্বামীকে নিয়ে সোনালী ব্যাংকে যেয়ে সকল ফরম পূরণ করে মাসিক ৫০০ টাকার একটি ডিপিএস খুলে দিলেন। সাবিনার স্বামী লেখাপড়া জানা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে টাকা জমার ফরম পূরণ করে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে আসত। এভাবে ১০ বছর প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে জমা দিয়ে ১০ বছর পর তিনি খুব সম্ভবত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পেলেন। ২০০৭ সালে সেই টাকা দিয়েই ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠালেন। এখন তাদের অবস্থা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। সাবিনা বেগমকে আর মানুষের বাসায় কাজ করতে হয়না। স্বামী একটা মুদি দোকান চালায়। অভাব অনটন গত ১০ বছরে আর স্পর্শ করতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ডিপিএসটা না থাকত, তবে সাবিনার পরিবারের পক্ষে একসঙ্গে লক্ষাধিক টাকা জমানো কখনও সম্ভব হতো না। সামান্য করে সঞ্চয় এক সময় ভাগ্য ফেরাতে সহায়তা করেছে।
মূলত মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখে আজকের এই লেখা। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে চাকরি করেন কিংবা ছোট খাটো ব্যবসা করেন, তাদের জন্যই সঞ্চয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা কাল্পনিক ঘটনা বর্ণনা করি। যদিও বর্ণিত ঘটনা অনেকের সঙ্গেই মিলে যাবে। সোনিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। স্বামী এবং দুই সন্তান নিয়ে সংসার। বাবার বাড়ির সম্পত্তি ভাগ হবার পর সোনিয়া খাতুন যে পরিমাণ জমি পায়, সেটি বিক্রি করে কুড়ি লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা তার হাতে আসে। স্বামী আরিফুল ইসলাম একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্যাশ বিভাগে চাকরি করেন। সংসারে আর্থিক সমস্যা নাই। সবকিছুই ভালভাবে চলছে। যেহেতু সংসারে তেমন কোন সমস্যা নেই, তাহলে সোনিয়া খাতুন এই কুড়ি লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কি করবে? স্বামীর পরামর্শে সে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন। আরিফুল ব্যাংক কর্মকর্তা হবার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইএফটি (ইলেক্ট্রনিক ফান্ডস্ ট্রান্সফার) সেবা সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। এর ফলে প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার প্রায় ২০ হাজার টাকা তার স্ত্রীর অন্য একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে অটোমেটিক জমা হয়ে যাচ্ছে। সেই বাণিজ্যিক ব্যাংকেই সোনিয়ার নামে একটি মিলিয়নিয়ার ডিপিএস হিসাব খোলা হলো। এই মিলিয়নিয়ার ডিপিএস হিসাবে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা তার সেভিংস হিসাব থেকে জমা হবে এবং ৫ বছর পর ১০ লাখ টাকার মালিক হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রতি মাসে সোনিয়া তার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাবদ প্রায় ২০ হাজার টাকা তার সঞ্চয়ী হিসাবে পাবেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা মিলিয়নিয়ার ডিপিএস হিসাবে ৫ বছর মেয়াদে জমা রাখবেন এবং বাকি প্রায় ৮ হাজার টাকা পরিবারের প্রয়োজনে কিংবা অন্য যে কোন প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারবেন। এখানে একই সঙ্গে দুইটি প্রয়োজন পূরণ হয়ে যাচ্ছে। এক. মুনাফার একটা অংশ দিয়ে ৫ বছর পর ১০ লাখ টাকা পাওয়া পাবে। দুই. দৈনন্দিন প্রয়োজনেও মুনাফার টাকা ব্যয় করতে পারবে। কোন বাড়তি কষ্ট করতে হচ্ছে না। সবই অটোমেটিক। বর্তমানে চালু হওয়া ইএফটি ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো ও মুনাফা সংগ্রহ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। গ্রাহক ইএফটি সেবার সুযোগ পাবার ফলে সঞ্চয়পত্রের টাকার জন্য বই জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না। মাস শেষে মুনাফার টাকা ও মেয়াদ শেষে আসল টাকা সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাচ্ছে। আর টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস ও ইমেইল করে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আমাদের সাধারণ মানুষদের অনেকের ব্যাংক ভীতি আছে, বিশেষ করে অশিক্ষিত মানুষদের। যে কারণে অনেকেই নামসর্বস্ব ভুয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট অতি উচ্চ মুনাফার আশায় কষ্টের সঞ্চিত অর্থ জমা রাখেন। কিছুদিন পরে দেখা যায়, ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। চোখের জল হয় একমাত্র সম্বল। অনেক ঘটছে এরকম ঘটনা। যতদূর জানা যায়, টাইটানিক যখন ডুবছিল তখন কাছাকাছি তিনটে জাহাজ ছিল। একটির নাম ছিল স্যাম্পসন। মাত্র সাত মাইল দূরে ছিল সেই জাহাজ। ওরা দেখতে পেয়েছিল টাইটানিকের বিপদ সংকেত, কিন্তু তারা বেআইনিভাবে সিল মাছ ধরছিল। যদি ধরা পড়ে যায় তাই তারা উল্টোদিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে বহুদূরে চলে যায়। দ্বিতীয় জাহাজটির নাম ক্যালিফোর্নিয়ান। মাত্র চৌদ্দ মাইল দূরে ছিল টাইটানিকের থেকে সেই সময়। ওই জাহাজের চারপাশে জমাট বরফ ছিল। ক্যাপ্টেন দেখেছিলেন টাইটানিকের বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুক‚ল ছিল না এবং ঘন অন্ধকার ছিল চারপাশে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘুমোতে যাবেন। সকালে দেখবেন কিছু করা যায় কিনা। শেষ জাহাজটির নাম ছিল কারপাথিয়ান্স। এই জাহাজটি আসলে যাচ্ছিল উল্টোদিকে। ছিল প্রায় আটান্ন মাইল দূরে। যখন ওরা রেডিওতে শুনতে পায় টাইটানিকের যাত্রীদের আর্ত চিৎকার। জাহাজের ক্যাপ্টেন পূর্ণশক্তিতে বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে চলেন টাইটানিকের দিকে। এই জাহাজটির এই সিদ্ধান্তের জন্যেই টাইটানিকের সাত শ পাঁচজন যাত্রী প্রাণে বেঁচে যান।
বিপদ আপদ বলে কয়ে আসে না। যদি বিপদের সময় সহায়তা পান, তবে অবশ্যই ভাল। কিন্তু যদি না পান, তবে অবশ্যই নিজের সম্বল দিয়েই বিপদ থেকে উতরে যাবার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ভাল বেতনে চাকরি করেন। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন,পরিবারের অনেক অন্যায় আবদার মেটাতে যেয়ে তার সঞ্চয়ের ঝুলি শূন্য থেকে যায়। বড় ধরনের বিপদে পড়লে, অন্যের অনুগ্রহের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এটা কারও কাম্য হতে পারে না। আবার অনেকেই আছেন, তাদের মাসিক সামান্য সঞ্চয় দিয়ে ডিপিএস করে মোটামুটি বড় অংকের টাকা জমিয়ে ফেলেন। সেই টাকা দিয়ে তারা নিজেদের কিংবা পরিবারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। অনেকেই আবার সেই জমানো টাকা দিয়ে সঞ্চপত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। সঞ্চয়পত্র আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেকের কাছেই একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ মাধ্যম। যে কারণে নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং নির্ধারিত সময়ে প্রাপ্য মুনাফার আশায় তারা সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী তাদের অবসরোত্তর প্রাপ্ত অর্থ বিভিন্ন কারণে খরচ না করে পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। একটা কথা বলে রাখা ভাল, খরচ করতে চাইলে আপনি হাজারো উপায় পেয়ে যাবেন। যাই হোক, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ফলে তিন মাস পর পর তারা নির্দিষ্ট অঙ্কের মুনাফা পেয়ে থাকেন। এই মুনাফার টাকা দিয়ে শেষ বয়সে অন্যের গলগ্রহ থেকে রক্ষা পেয়ে থাকেন। একজন মানুষের যখন চাকরি কিংবা ব্যবসা করার শক্তি, সামর্থ্য থাকে না, তখন মাসে দশ হাজার টাকা যদি নিয়মিত আয় হয় সেটাও কম নয়। আর বৃদ্ধ বয়সে সেটি হয় আরও বেশি কার্যকর। প্রতি মাসে প্রাপ্ত মুনাফার টাকা তারা তাদের পরিবারে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীরা তিন মাস মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমেও তিন মাস অন্তর মুনাফা পেয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে তাদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। স্কুল জীবনের প্রতি ক্লাসেই পড়া সারাংশটি আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত, ‘মুখে অনেকেই টাকাকে তুচ্ছ, অনর্থের মূল বলেন থাকেন, কিন্তু জগত এমন এক ভয়ানক স্থান যে টাকা না থাকলে তাহার স্থান কোথাও নাই । সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই, ভ্রাতা-ভগ্নির নিকটে নেই, স্ত্রীর নিকটে নেই। স্ত্রীর ন্যায় ভালবাসে, এমন বলতে জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসাও নাই । কারও নিকট সম্মান নেই । টাকা না থাকলে রাজায় চিনেনা, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্রই টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তে টাকা, জগতে টাকারই খেলা।’ সেজন্যই পারিবারিক সচ্ছলতার প্রতি আমাদের সঞ্চয়ের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।