পাগলাটে এক রাতের পর এখনো স্থির হতে পারিনি। ঘোরলাগা সময়। লুসাইলে যা ঘটেছে তা কি সত্যি? নাকি অলিক কল্পনা? নাটকীয় ১২০ মিনিটের স্ক্রিপ্ট রাইটারইবা কে? প্যারালাল কোনো জগতে কি তা লেখা হয়েছে? রহস্যময় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। বহুকিছুই আমরা এখনো জানি না। কোনোদিন জানতে পারবো- তারও নিশ্চয়তা নেই।
দ্য গার্ডিয়ানে সীড লো লিখেছেন, ‘ইট ওয়াজ ডান।’ এর মানে আপনার না বোঝার কথা নয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। এই একটি ছবির জন্য কতো অপেক্ষা, প্রার্থনা, কান্না। অবশেষে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ফুটবল মহানায়ক কম দেখেনি। কিন্তু এ খেলায় মেসির মতো কেউ কোনোদিন আসেনি, সম্ভবত আসবেও না।
বিজ্ঞাপন
কেন বলছি- তার ব্যাখ্যায় খানিক পরে আসছি। এমনিতে লিওকে নিয়ে লেখা ভীষণ কঠিন। তাকে ডিফেন্ড করার মতোই। অনেকের মতেই এ বিশ্বকাপের সেরা ডিফেন্ডার ক্রোয়েশিয়ার ইয়োসকো গার্দিওলের কথা শোনেননি? সেমিফাইনালে মেসিকে শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারেননি। তবে চেষ্টা করে গেছেন পুরো ম্যাচই। পরে বলেছেন, ‘‘ছেলে-পুলেদের কাছে গল্প করতে পারবো আমি মেসির বিরুদ্ধে খেলেছি।’’ মেসিকে নিয়ে লেখা কেন কঠিন? তাকে নিয়ে লেখা হয়নি এমন কিছু কি আসলে আছে!
রোজারিওর ছোট্ট জাদুকর। শারীরিক সমস্যা ছিল। খুব অল্প বয়সে যোগ দেন বার্সেলোনায়। ১৬ বছরে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক। এই তো সেদিন পর্যন্ত কাতালান ক্লাবটিই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। একেবারে শুরুতে টিস্যু পেপারে তাকে সই করিয়েছিল বার্সেলোনা। বিদায় বেলায় ক্লাব ছাড়েন সেই টিস্যু পেপারে চোখ মুছতে মুছতেই। এতটা আবেগি লিওকে কখনো দেখা যায়নি। এসব গল্প সবারই জানা। সাত ব্যালন ডি অর, চার চ্যাম্পিয়নস লীগ, এক কোপা আমেরিকা, ১০ স্প্যানিশ লীগ, এক ফ্রেঞ্চ লীগ। তার শোকেসে কী নেই! তবুও একটা কিছু ছিল না। যার অপূর্ণতা মুছে গেল লুসাইলে। বিবিসি’র চিফ ফুটবল রাইটার ফিল ম্যাকনাল্টির লেখা পড়ছিলাম। তিনি লিখেছেন, ‘‘বিশ্বকাপ ট্রফিটি যখন তিনি তুলে ধরেন, তখন স্টেডিয়ামজুড়ে চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা। মেসি তার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তার বর্ণাঢ্য সংগ্রহশালায় যে একটিমাত্র কমতি ছিল, সেটি অর্জন করলেন ইতিহাসের সবচেয়ে দর্শনীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে। মেসিই যে সর্বকালের সেরা, সেই বিতর্কের মীমাংসায় তার কোটি কোটি ভক্ত এই ট্রফিটিকেই প্রধান আর্গুমেন্ট হিসেবে তুলে ধরবেন এখন থেকে। খাঁটি সোনায় তৈরি প্রায় ১৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই ট্রফিটির জন্যই অসংখ্য মানুষ নিঃসন্দেহে মেসিকে সর্বকালের সেরার স্বীকৃতি দিবে। এর বিপরীতে যারা তাদের এখন যুক্তি উপস্থাপন করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। প্রত্যেক প্রজন্মেই খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা হয়ে আসছে, যা তর্ক-বিতর্ককে ভিন্নমাত্রা দেয়। কিন্তু মেসি যে নিজেকে পেলে ও আরেকজন গ্রেটের (ম্যারাডোনা) কাতারে নিয়ে গেছেন যার ছবি রোববার লুসাইল স্টেডিয়ামে বহু আর্জেন্টাইনের হাতে থাকা ব্যানারে শোভা পাচ্ছিল তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।’’
সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় কে? রোববার রাতের পর সে বিতর্ক কি শেষ হয়ে যাবে? না, এটি আসলে শেষ হওয়ার মতো নয়। তবে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই একটি রাত মেসিকে নিয়ে গেল পেলে-ম্যারাডোনার কাতারে। এমনিতে মেসি শুধু ফুটবলার নন। তাকে সবসময়ই মনে হয় ক্লাসিক এক শিল্পী। যার বাঁ পায়ে তৈরি হয় নানা ছবি, সংগীতের সুর কিংবা কবিতার ছন্দ। মেসি কেন মাঠে হাঁটেন বছর দুয়েক আগে সেটির অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সাবেক গুরু পেপ গার্দিওলা। তখন তাকে আসলে একজন ঋষিও মনে হয়। যিনি হেঁটে চলেন আপন মনে। গার্দিওলা বলেন, ‘ও কিন্তু দৌড়াচ্ছে না, কিন্তু ও দেখছে সবসময়। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের কোথায় দুর্বলতা আছে সেটি খুঁজে বের করে সে। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ও মাথায় একটি মানচিত্র তৈরি করে ফেলে, কোথায় ফাঁকা জায়গা আছে।’
মেসির মতো কেউ কখনো আসেনি, কেন বলছি সে কথা। একজন ফুটবলার বিশ্বকাপ জিতুক সারা দুনিয়া এভাবে কখনো চেয়েছে আপনি দেখাতে পারবেন? ফাইনালের আগে দিদিয়ের দেশমের বলা কথাটাই স্মরণ করুন না কেন? বলেছিলেন, এমনকি কিছু ফরাসি নাগরিকও মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চায়। তার আগে খেয়াল করুন। কোপা জেতার পর এমিলিয়ানো মার্টিনেজের বলা কথাটায়। মেসির জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারেন। একজন খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপ জেতাতে পুরো টিম এভাবে একতাবদ্ধ হতেও আপনি কখনো দেখেছেন!
হেডলাইন আসলে নকল বা ধার করেছি ব্রাজিলিয়ান গ্রেট জিকোর কাছ থেকে। তিনি তার কলামে লিখেছেন, নাটকীয়, রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল শেষে লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ। অবশ্যই ফাইনালে কাপ জয়ের এত কাছাকাছি এসে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার যন্ত্রণা তাড়া করবে ফরাসিদের। কিন্তু মেসি এমন জাদুকর, যে জিতলে ফুটবলও খুশি হয়। সত্যি জিকোর বলা কথাটা একটুও বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না!