মাসব্যাপী ফুটবল বিশ্বযুদ্ধের অবসান। যুদ্ধের ম্যাজিশিয়ান মেসি। উচ্ছ্বাসে বুঁদ সমর্থকরা। কাতার থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার। তবে বিশ্বকাপের উন্মাদনার দূরত্ব নেই। আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের পর থেকে দেশে সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাস। রেশ এখনো চলছে। তবে কাতার বিশ্বকাপজুড়ে বিশ্বকাপ উল্লাস কাল হয়েছে অনেকের। ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুর্ঘটনা, পতাকা টাঙানো, সংঘর্ষসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয়েছেন অনেকে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বকাপ উন্মাদনায় দেশে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩৫ জনের বেশি। কাতার বিশ্বকাপের সময়কাল ঘিরে বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও ছাদ থেকে পরেও মৃত্যু হয়েছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে পরিবারগুলোর মধ্যে। ফ্রান্স-আর্জেন্টিনার ফাইনাল খেলা দেখে রোববার দিবাগত রাতে যশোরের ঝিকরগাছায় উল্লাস করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন রাকিব হোসেন (২২) নামের এক যুবক। খালে পড়ে তার মৃত্যু হয়। তিনি উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের ধোপাপাড়ার আসলাম হোসেনের ছেলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এলাকার উদ্যোগে ঝিকরগাছা পৌরসভার কাটাখাল বঙ্গবন্ধু পৌরপার্কে প্রজেক্টরের মাধ্যমে খেলা দেখানো হচ্ছিল। এ সময় আর্জেন্টিনার গোলে উল্লাস করতে গিয়ে রাকিব হোসেন কাটাখালের ভিতর পড়ে যায়। এতে তার পেটে লোহার রড ঢুকে যায়। দ্রুত ঝিকরগাছা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন তাকে। একই দিনে আনন্দ মিছিল করতে গিয়ে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় কুমিল্লায় মোহাম্মদ শাওন (১১) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। আহত হন আরও একজন। মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা ইউনিয়নের পূর্ব বাতাড়িয়া এলাকার কুমিল্লা-নোয়াখালী সড়কে রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে লাকসাম ক্রসিং হাইওয়ে থানার এসআই ফারুক হোসেন জানান। শাওন ওই গ্রামের বড় বাড়ির বাসিন্দা পত্রিকা বিক্রেতা মিলন মিয়ার ছেলে এবং খিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
বুধবার জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শাহরিয়ার খান শ্রাবণ (১৭) নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ওইদিন ভোর রাতে আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ফুটবল খেলা দেখে বালিজুড়ী যাওয়ার পথে তারা দুর্ঘটনার শিকার হন। একইদিন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে তারিকুল মোস্তাক রানা (৪৮) নামে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার মৃত্যু হয়। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
বিশ্বকাপজুড়েই পতাকা টাঙানো নিয়ে থাকে বাড়তি উন্মাদনা। এতেও অনেকের প্রাণ হারাতে হয়েছে এ বছরও। এ পর্যন্ত পতাকা টাঙাতে গিয়ে ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছয়জন ও ছাদ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। এদের সবার বয়স ১৩-১৯ বছরের মধ্যে। ১৯শে নভেম্বর সকালে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাবিল হোসেন (১৬) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। নাবিল ওই এলাকার ফরাজি বাড়ির মো. মুরাদের বড় ছেলে এবং স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একইদিন সন্ধ্যায় ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে বিদ্যুতের খুঁটিতে আর্জেন্টিনার পতাকা টানাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় শামিম (১৭)। সে পৌর শহরের ষোলহাসিয়া এলাকার হামিদুল ইসলামের ছেলে। একই ঘটনায় শামছুল হকের ছেলে সাজ্জাদ (১৯) গুরুতর আহত হন। ১৬ই নভেম্বর টাঙ্গাইলের সখীপুরে পাঁচতলা ভবনের ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তানভীর হাসান তন্ময় (১৩) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তন্ময় উপজেলার প্রবাসী সোহেল রানার ছেলে ও সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভ. স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ১১ই নভেম্বর নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আড়ানগর ইউনিয়নের সিংগারুল গ্রামে ব্রাজিলের পতাকা ওড়াতে গিয়ে বাড়ির টিনের চালে ওঠার পর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গণেশ সিং (১৮) নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়। ৮ই নভেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর মাস্টার এলাকায় গাছে উঠে আর্জেন্টিনার পতাকা টানানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান দীপেন ত্রিপুরা (১৯) নামের এক কলেজছাত্র। ৭ই নভেম্বর কক্সবাজার সদর থানার তারাবনিয়াছড়া এলাকায় ব্রাজিলের পতাকা ওড়ানোর সময় ছাদ থেকে পড়ে মোহাম্মদ মুসা (১৬) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়।
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায়ও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সমর্থকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার জেরে ছুরিকাঘাত ও মারধরে সাভার, চাঁদপুর, বাগেরহাট, হবিগঞ্জের বাহুবল ও ভোলায় পাঁচজন নিহত হন। নিহতরা হলেন- সাভারের হাসান, চাঁদপুর সদরের মেহেদী হাসান, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের টুটুল হাওলাদার, বাহুবলের আব্দুস সহিদ ও ভোলা সদরের মো. হৃদয়।
ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে মৃত্যু ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে জড়িয়ে আহতের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৩৫ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা নিয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় সংঘর্ষে জড়িয়ে অন্তত সাতজন আহত হন। এরমধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে পাঁচজনকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা হলেন, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামের মোফাজ্জল হোসেন (৪৫), সায়েম আলী (৫৫), অমিত (২৩), জুয়েল (৩৫), শিপন (৩৭), বিজয় (৩৫) ও চাঁদ আলী (৩৬)। এর আগে ১০শে ডিসেম্বর রাতে রাজশাহীর রাজপাড়া থানার নতুন বিলশিমলার বন্ধ গেট এলাকায় কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের হারের পর আর্জেন্টিনা সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্রাজিল সমর্থকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ সময় দুজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। ৬ই ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে ভোলার সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের চেউয়াখালী গ্রামে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষেও আটজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৩রা ডিসেম্বর লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা রেলস্টেশন এলাকায় আর্জেন্টিনার পতাকা চুরি হওয়ার ঘটনায় ব্রাজিল সমর্থকদের সঙ্গে দলটির সমর্থকদের বাক?বিতণ্ডার পর সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন, যার মধ্যে দুজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ২৩শে নভেম্বর বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে যায় দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। এ নিয়ে খেলা শেষে ঢাকার সাভার উপজেলার বক্তারপুর এলাকার এবং গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ মার্কাস মহল্লায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের পৃথক সংঘর্ষে ৭ জন আহত হন।