ফুটছে আতশবাজি-পটকা। ঢোল পিটিয়ে চলছে নাচ। সঙ্গে ভুভুজেলার শব্দ। কানেই কিছু শোনা দায়। বাদ যাচ্ছিল না ভিডিও করা, সেলফি তোলা। থামেনি তর্কবিতর্ক, হইহুল্লোড় ক্ষণিকের জন্য।
বিশাল পর্দার সামনেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছিল না। এর মধ্যেও অনেক নারী জায়গা করে নিয়ে খেলা দেখছিলেন বড় পর্দায়। খেলা শেষে আর্জেন্টিনার জয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লেন সবাই।
বড় পর্দায় রোববার রাজধানীর পান্থপথ–সংলগ্ন বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা দেখার আয়োজন করা হয়। সেখানেই দেখা যায় এমন চিত্র। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ না খেললেও খেলা দেখা নিয়ে দেশের মানুষের উন্মাদনার কথা এখন বিশ্ববাসীরও অজানা নয়।
ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনা খেলা শুরুর অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়ে। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে এর প্রকাশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো অফিসে সাধারণত বাইরের শব্দ ঢোকে না। কিন্তু রাত আটটা বাজার আগেই ভুভুজেলা ও সাউন্ড বক্সের শব্দ অফিসের ভেতর থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। অফিসের নিচে নামতে বোঝা গেল, কাঁচাবাজারের ওখান থেকে সাউন্ড বক্সের শব্দ আসছে। গিয়ে দেখা গেল, ছোট একটি টিভি চলছে, সঙ্গে বড় তিনটি সাউন্ড বক্স বাজছে। আর অনেক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে।
কাঁচাবাজার থেকে কারওয়ান বাজার মোড়ের দিকে আসতে দেখা গেল, দলে দলে মানুষ রাস্তা পার হয়ে ভুভুজেলা বাজিয়ে বসুন্ধরা শপিংমলের দিকে যাচ্ছেন। সাড়ে আটটার দিকেই বসুন্ধরার সামনের ফুটপাতের বেশ কিছু দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়। ফুটপাতে জামাকাপড়ের বিক্রেতা মো. শুভ নামের একজন বন্ধ করার জন্য দোকান গোছাচ্ছিলেন। শুভ বলেন, ‘বসুন্ধরার সামনে বড় পর্দায় খেলা দেখব, তাই বন্ধ করে দিলাম।’
বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, শত শত মানুষ খেলা শুরুর আগেই ভিড় করেছেন। তখনই ভুভুজেলা, পটকা ও মানুষের চিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে পড়ে। আর দুই পাশেই একটা করে লাইন ছাড়া যানবাহনের চলাচল মানুষের ভিড়ে প্রায় বন্ধ।
কেবল পুরুষেরাই নয়, বড় পর্দায় খেলা দেখতে বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে হাজির হন অনেক নারীও। তাঁদের মধ্যে অনেকে বান্ধবীরা মিলে এসেছেন, কেউ স্বামীর সঙ্গে, কেউবা অন্য প্রিয়জনের সঙ্গে। নারীরা সংখ্যায়ও ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
কয়েকজন বান্ধবী মিলে গ্রিন রোড থেকে খেলা দেখতে আসেন শিক্ষার্থী মিথিলা বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় বসে খেলা দেখলে এক্সাইটমেন্ট প্রকাশ পায় না; যেটা সবাই মিলে দেখলে পায়। তাই সবার সাথে খেলা দেখতে এসেছি।’ তাঁর সঙ্গে আসা আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘শুধু এটুকু বলব, আমরা খুব এক্সাইটেড।’
রাত ৯টায় খেলা শুরু হতেই চিৎকার। আর মেসি বল পেলে তো ‘মেসি মেসি’ রব ওঠে। গোলের সুযোগ মিস করলেই ভুয়া ভুয়া রবও উঠছিল। আবার এমবাপ্পের হাতে বল গেলেও চিৎকার শুরু হয়ে যায়।
আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সঙ্গে ফ্রান্সের সমর্থক ও আর্জেন্টিনার সমর্থক নন—এমন খেলাপ্রেমীদের চলছিল তর্কযুদ্ধ। শুরুর দিকে মেসির পায়ে বল যেতেই একজন বলেন, ‘মেসি ভাই, মারো…।’ পাশের আরেকজন বলেন, ‘চিল্লাইলে লাভ নাই। একটু পরেই গোল খাবে।’
আর্জেন্টিনার একজন খেলোয়াড় ‘ফাউল’ করতেই এক দর্শক বলে ওঠেন, ‘মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনার কেউ ভালোভাবে খেলে না।’ আরেকজন বলেন, ‘আর্জেন্টিনা সবচেয়ে ভদ্র দল।’ চলতে থাকে এমন নানান কথা।
এদিকে পেনালটি শটে আর্জেন্টিনা প্রথম গোল পেলে তীব্র উচ্ছ্বাস দেখা যায় পর্দার সামনে। তবে দ্বিতীয় গোলে দর্শকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল আরও বেশি। প্রথমার্ধের খেলা শেষে একদিকে ছিল যেমন উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে উত্তেজনা।
দ্বিতীয়ার্ধে যখন ফ্রান্স প্রথম গোল দেয়, তখন দর্শকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস কিছুটা কমে আসে। এমবাপ্পে দ্বিতীয় গোল দিলে ভুয়া ভুয়া রব ওঠে।
দুই গোল খাওয়ার পর আর্জেন্টিনার কোনো খেলোয়াড় একটু মিস করলেই গালিগালাজ করছিলেন আর্জেন্টিনা সমর্থক মনোয়ার হোসেন। খেলা শুরুর পর থেকেই ভীষণ রকম উত্তেজিত ছিলেন ফার্মগেটের গ্রিন সুপার মার্কেটের মালামাল টানা এই ভ্যানচালক। তাঁরা প্রায় ৫০ জন মিলে খেলা দেখতে এসেছেন। প্রথমার্ধের খেলা শেষে মনোয়ার বলছিলেন, ‘অর্ধেক সময়ে দুইটা গোল দিছি, তারপর আরও ২টা গোল দেব।’ অবশ্য পরের অর্ধেক সময়ে আর্জেন্টিনা ২ গোল হজম করার পর বেশির ভাগ সময় মন খারাপ করে কাটান তিনি।
অতিরিক্ত সময়ে মেসি গোল দিলে এত উচ্ছ্বাস দেখা যায়, যা বলে বোঝানো কঠিন। দেশে যে আর্জেন্টিনার অগণিত সমর্থক, তা টের পাওয়া যাচ্ছিল। তবে এরপর আবার যখন ফ্রান্স পেনাল্টিতে গোল দিল, তখন একজন বলেন, ‘এটা খেলা, নাকি মিরাক্কেল।’ আরেকজন বলেন, ‘ফাইনাল খেলা ফাইনালের মতোই হচ্ছে।’
পেনাল্টি শেষে আর্জেন্টিনা জিতলে সজীব নামের এক ফ্রান্স–সমর্থক বলেন, ‘বুকের ব্যথা বুকে, এটা বলে লাভ নাই।’
ব্রাজিল সমর্থক শারমিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেসির শেষ বিশ্বকাপ, ও পেয়েছে ভালোই হলো।’ শামীম নামে এক আর্জেন্টিনা সমর্থক বলেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক। এটা মেসি ডিজার্ভ করে। শেষ পর্যন্ত অসাধারণ হয়েছে।’
খেলা শেষে ‘মেসি মেসি মেসি’—স্লোগান তুলে মিছিল করতে করতে ঘরে ফেরেন আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা।