বরিশাল বিএনপি :টাকার বিনিময়ে পদ :কমিটি ভাঙা-গড়ার অভিযোগ :তদন্ত কমিটি গঠন
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
প্রভাবশালীদের পছন্দ আর টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রির গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বরিশাল বিএনপি। যে কারণে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া।
প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় বাতিল হয়েছে বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির কমিটি। এরপর হওয়া কমিটির বিরুদ্ধেও প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতো অধস্তন কমিটি ভাঙা-গড়ার অভিযোগ উঠেছে।
পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে বরিশাল (উত্তর) জেলা বিএনপির বিরুদ্ধে। বিভিন্ন উপজেলা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে-এমন অভিযোগ গেছে কেন্দ্রে। এসব অভিযোগ তদন্তে গঠন করা হয়েছে কমিটি। ১৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত ওই কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
৩ বছর আগে তৃণমূলে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ২১-র ৩ নভেম্বর ভেঙে দেওয়া হয় বরিশাল মহানগর-উত্তর ও দক্ষিণ জেলার কমিটি। এরপর দক্ষিণ জেলায় নানা ইউনিট-কমিটি গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ান প্রভাবশালী নেতারা। উত্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠে টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রির অভিযোগ। এরই মধ্যে গত বছরের ১৫ নভেম্বর ভেঙে দেওয়া হয় দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি। নয়া আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের দায়িত্ব পান যথাক্রমে সাবেক এমপি আবুল হোসেন এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহিন।
কমিটি ভেঙে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান নান্টু বলেন, ‘সমস্যার মধ্যে শুধু এটুকু দেখি যে দুই প্রভাবশালী নেতার পছন্দ অনুযায়ী কমিটি দেইনি আমরা।
ওই দুই নেতাও আজন্ম বিএনপি করা কেউ নয়। ১৯৯৩ সালে জাসদ থেকে এসে বাকেরগঞ্জের এমপি হওয়া আবুল হোসেন নিজের পছন্দমতো কমিটি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত। একইভাবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় ফেরদৌস আহম্মেদ কোরেশীর দল থেকে বিএনপিতে আসা সরফুদ্দিন সান্টু চেয়েছিলেন বানারীপাড়ায় তার প্রেসক্রিপশনে কমিটি হোক। কিন্তু আমরা সুযোগ দেই ত্যাগী-পরীক্ষিতদের। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা নানা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে চলেছেন।’
অ্যাডভোকেট নান্টুর এই অভিযোগের সত্যতা মেলে নয়া আহ্বায়ক আবুল হোসেনের বক্তব্যে। সাবেক এমপি এবং জাতীয় নির্বাচনে যারা মনোনয়ন প্রার্থী তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা না করে তিনি ইচ্ছেমতো কমিটি দেওয়ার অভিযোগ করেন নান্টু-মেবুলের বিরুদ্ধে। এসব কারণে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বে থাকাকালে বাকেরগঞ্জ উপজেলা ও পৌর, বানারীপাড়া পৌর, বাবুগঞ্জ এবং বরিশাল সদর উপজেলায় নতুন কমিটি করেন নান্টু-মেবুল।
এরপর দায়িত্ব পেয়ে বাকেরগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার সেই কমিটি ভেঙে দেন আবুল-শাহিন। গঠন করেন নতুন কমিটি। এই কমিটি নিয়েই বাধে জটিলতা। বাকেরগঞ্জ উপজেলা কমিটি নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অপরদিকে বরিশাল সদরের কমিটি অন্যায়ভাবে ভাঙার অভিযোগ দেওয়া হয় মহাসচিবের কাছে। বাকেরগঞ্জের নয়া কমিটির আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ জমাদ্দারের বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে যোগদান এবং এই অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার অভিযোগ করে সদ্য সাবেক আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ সিকদার বলেন, ‘সদস্য সচিব পদে আসা নাসির হাওলাদারের পরিবার বহুরূপী। নাসিরের এক ভাই জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। অন্যরাও আছেন নানা দলে। মূলত একক অধিপত্য বজায় রাখতেই এটা করেছেন আবুল হোসেন। এখানে বিএনপি নয়, যারা আবুল দল করে তাদের নিয়ে চলেন তিনি। টানা ২২ বছর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। ২০১৮ সালে তার পছন্দে কমিটি করতে জেলা বিএনপি রাজি না হলে কেন্দ্র থেকে ১১৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি পাশ করিয়ে আনেন আবুল। সেখানে তিনি ছিলেন আহ্বায়ক এবং বাকিরা সদস্য। কোনো সদস্য সচিব ছিলেন না। বিএনপির ইতিহাসে এমন কমিটি আর কোথাও হয়নি।’
অভিযোগের ব্যাপারে আবুল হোসেন বলেন, ‘উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় চাপে পড়ে ১৫ আগস্টের কর্মসূচিতে যোগ দেন হারুন জমাদ্দার। নাসির হাওলাদার বহু বছর ধরে বিএনপি করেন। সব ইউনিয়ন নেতাদের সম্মতিক্রমে নতুন কমিটি করা হয়েছে। যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তার একটিও সত্য নয়।’
বরিশাল সদর উপজেলার সদ্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। নুরুল আমিনকে আহ্বায়ক ও রফিকুল ইসলাম সেলিমকে সদস্য সচিব করে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি ঘোষণা হয় চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। নয়া কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সদর উপজেলার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী এনায়েত হোসেন বাচ্চুকে। বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক নুরুল আমিনের অভিযোগ, ‘কোনো কারণ ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে ভেঙে দেওয়া হয়েছে আমাদের কমিটি। নতুন আহ্বায়ক টানা ১০ বছর ছিলেন সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি। এই ১০ বছর নিষ্ক্রিয় থাকা ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই সদর উপজেলা বিএনপির। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমি যেখানে প্রায় ২ ডজন মামলা খেয়েছি, জেল খেটেছি সেখানে বর্তমান আহ্বায়কের জেলে যাওয়া তো দূরের কথা, একটি মামলার আসামিও হতে হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমি মহাসচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
অভিযোগ বিষয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহিন বলেন, ‘পূর্বের কমিটি করার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক নিয়ম মানা হয়নি। কমিটি করার সময় সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট বাচ্চু হজে ছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন দেশে আসার পর কমিটি করতে। সেই অনুরোধও রাখা হয়নি। এসব বিবেচনায় কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করা হয়েছে।’
উত্তর জেলা বিএনপির আওতাধীন নানা উপজেলা কমিটি গঠন নিয়েও চলছে জটিলতা। এখানে দায়িত্বরত আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ টাকার বিনিময়ে দলীয় পদ-পদবি বিক্রির। এই অভিযোগে উপজেলা আগৈলঝাড়া-গৌরনদী থেকে শুরু করে মুলাদী এমনকি বরিশাল নগরে দফায় দফায় বিক্ষোভ আর ঝাড়ু মিছিল করেন নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, এক সময় বাসে ওঠার ভাড়া না থাকা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান মুকুল এখন আকাশপথে ঢাকায় যাওয়া-আসা করেন। তিনি ও আহ্বায়ক দেওয়ান মো. শহিদুল্লাহ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংস্কারপন্থিদের নিয়ে কমিটি করছেন। মুকুল নিজেও এক সময় জাতীয় পার্টি করতেন। পদবাণিজ্য করে এই দুই নেতা কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অভিযোগ সম্পর্কে উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘উত্তর জেলার অনেক নেতা আছেন কেন্দ্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে। সবাই চান পছন্দমতো কমিটি। তাদের পছন্দমতো পদ দিতে না পারার কারণেই এসব মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’
দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি’র মতো একটি বড় দল যেখানে নেতা হওয়ার মতো অনেক যোগ্য লোক আছে সেখানে পদ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ থাকতেই পারে। পদ বাণিজ্যের যেসব অভিযোগ উঠেছে তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। ২ সদস্যের তদন্ত কমিটিও করেছে কেন্দ্র। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযোগ তদন্তে কেন্দ্রের করা কমিটির প্রধান দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমি বরিশালে যাব অভিযোগের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। বরগুনা এবং পিরোজপুরের কিছু অভিযোগও রয়েছে। মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে যা পাব তা জানাব কেন্দ্রকে। তারপর কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।’