বরিশালে নিরব নির্যাতনের শিকার ১৮ বস্তির নারীরা : আক্রান্ত হচ্ছে মানষিক রোগে
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১:২৬ অপরাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
মামুনুর রশীদ নোমানী :
নির্যাতনে শিকার হচ্ছে নারীরা। প্রতিবাদ করতে গেলে শুনতে হচ্ছে কটূক্তি। নিরব থেকেই এই নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে নারীদের। ভয়ে গোসল না করেই ফিরছেন অনেক নারীরা। যে কারনে অল্প বয়সেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরা। চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু বরন করছেন এক শ্রেণীর নারী। বরিশালে ছোট বড় মিলিয়ে ১৮ টি বস্তি রয়েছে। এই বস্তি গুলোতে বসবাস করছে হাজার হাজার নারী। শুধু বস্তি নয় বরিশাল সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগঞ্জে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে নারীরা। এ সব নারীদের মধ্যে অনেকেরই পাকা বাথরুম না থাকায় গোসল নিয়ে অনিরাপত্তায় ভুগতে হয়। গোসল করতে হচ্ছে খোলা উন্মুক্ত স্থানে। ফলে প্রতিদিনই নির্যাতিত হতে হচ্ছে নারীদের। ঘনবসতি বস্তি গুলোতে ৩০/৪০টি পরিবারের জন্য গোসল খানা ও বাথরুম রয়েছে একটি। যেখানে সকাল হলেই প্রতিদিন লাইন দেখা যায় নারী পুরুষদের। দুপুরে তো কথাই নেই। বেশি ভাগ সময় গোসল না করে থাকতে হচ্ছে নারীদের। বিভিন্ন এলাকা গুলোতে দেখা যায় ১০ থেকে ১৫ টি পরিবারের জন্য একটি গোসলখানা ও একটি টয়লেট রয়েছে। এমনকি গ্রাম গুলোতেও একই অবস্থা। এসব গোসলখানা ও টয়লেট নারী পুরুষ সকলেই ব্যবহার করছেন। এসব গোসলখানা ও টয়লেটে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই। দরজা ভাঙ্গা কোনটার আবার দরজা নেই। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে দরজা আছে ছাদ নেই খোলা আকাশের নিচে গোসল ও বাথরুম করতে হচ্ছে। যার ফলে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা। সম্প্রতি এক জরিপে এমন কিছু ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। বরিশাল নগরীর সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে নারীর স্বাস্থ্য ও ওয়াস নিয়ে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা কাজ করেতে গিয়ে তারা দেখেন গোসলের সময় ও বাথরুম করতে গিয়ে কি পরিমানে নির্যাতনে শিকার হচ্ছে নারীরা। সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা যায়, বস্তি, নিম্ন এলাকা ও গ্রামে বসবাস করা ৯৮ শতাংশ নারীদেরই উন্মুক্ত গোসলখানা ব্যবহার করতে হয়। এর মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ নারীদের জন্য আলাদা গোসল খানা রয়েছে। ফলে তাদের মৌখিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে বলে তথ্যে উঠে এসেছে। এদিকে ৭৭ শতাংশ মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতা বা ভয়ে থাকেন। কেউ গোসলের ছবি তুলছে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। একই সঙ্গে দরজায় লক নেই, অনেক সময় ভাঙ্গা,উপরে ছাদ না থাকার কারনে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঝুঁকিতে থাকতে হয় সব সময় । অনেক সময় গোলের দৃশ্য মোবাইলে ধারনা করে ব্ল্যাকমেল করা হয়। এদিকে রাতে বেলায় ভিন্ন দৃশ্য টয়লেটে যেতে ভয় পান তারা। ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোরী, যুবতী ও নারীরা বলছেন তারা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গিয়ে কোনা কোন সময় সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অনেক সময় লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন। পরিবারকে জানালে তারা উল্টো তাদের ভুল বুঝছেন। মৌখিক সহিংসতায় ৮০ দশমিক ১০ শতাংশ নারী শিকার হয়েছেন এবং ২০ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৪০ শতাংশ কিশোরী ও নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে নগরীর দপ্তর খানা এলাকার বাসিন্দা বলেন ৭/৮ টি পরিবার একটি গোসলখানা ব্যবহার করি। খোলা গোসলখানায় গোসল করতে হয়। পোশাক পাল্টাতে সমস্যা হয়।
barisal basti
প্রায় সময় পুরুষ লোকেরা দাঁড়ানো থাকে। সেক্ষেত্রে কোন রকম গায়ে পানি দিয়েই কাপড় বদলে চলে আসতে হয়। তাতে শরীরও ভিজেনা। পুরুষদের নোংরা কথা শুনতে হয়। এভাবে খোলা জায়গায় গোসল করা অস্বস্তিকর। নগরীর কেডিসি ও ভাডার খাল বস্তির একাধিক নারী ও কিশোরীরা জানান, বস্তিতে মেয়েদের জন্য কোন আলাদা গোসল খানা নেই। মাসিকের সময় মেয়েরা অবর্ণনীয় অস্বস্তির মধ্য দিয়ে পার করেন। মাসিকের ব্যবহৃত কাপড় তাৎক্ষনিক ভাবে পরিষ্কারের সুযোগ পান না। যে কারনে ঘরের মধ্যে অপরিষ্কার অবস্থা থাকতে হয় কখন বাথরুম খালি হবে। অনেক ক্ষেত্রে পরিস্কার করার সময় লোক চলে আসে। তখন কোন রকম পরিস্কার করে বের হয়ে আসতে হয়। এদের মধ্যে যারা প্যাড ব্যবহার করেন তারা সময় মতো প্যাড পরিস্কার করতে পারছেন না। এতে করে অনেকের ইনফেকশন করছে। রসুলপুরে বসবাসরত একাধিক নারীদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা জানান, গোসলের জন্য ঘন্টা পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তার পরে কোন রকম শরীরে পানি দিয়ে চলে আসতে হয়। বিশেষ করে অল্প বয়সের মেয়েদের নোংরা কথা শুনতে হয়। প্রতিবাদ করতে গেলে ঝগড়া বাদে মারামারি পর্যন্ত হয়। লাইনে দাঁড়ালে ঠেলামারে কিছু কইলে বলে বাথরুমে যাওয়া লাগবে কিসে লইগা। বাথরুমে জায়গা না থাকায় নদীর পাড়ে গোসল করতে গেলে একইভাবে ইভটিজিংএ শিকার হতে হয়। এদিকে অপর একটি সূত্রে জানা যায়, সরকার দেয়া ঘরগুলোর ও একই অবস্থা। সেখানেও নারীরা একইভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এদিকে জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছেন। সেই সাথে বাড়ছে বস্তির সংখ্যা। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার অভাবেগুলো নারী ও শিশু বাসিন্দাদের জন্য কঠিন ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে নিরাপদ গোসলখানা না থাকায়। পলাশ পুরের একাধিক কিশোরীর সাথে কথা বলতে গেলে তারা জানান, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে গোসলের সুযোগ পাওয়া গেলেও কোন রকম গোসল করতে হয়। দুপুরের সময় গোলের চাপ বেশি থাকে। ওই সময় পুরুষরা দখলে রাখেন গোসলখানা। অনেক সময় অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত এসে যায়। পরে আর গোসল করা হয় না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মাসিকের সময়। প্রায় আতঙ্কে থাকতে হয় কেউ যদি গোলের দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় কিনা। এমন ঘটনাও ঘটেছে এখানে। নগরীর কলোনির একাধিক বাসিন্দা জানান, এখানে খোলা বাথরুমে গোসল সময় সমস্যা হয়। মালিকের সময় অস্তত্বি বেশি হয়। কারন দিনের বেলায় পুরুষদের আনাগোনা বেশি। এখানকার নারীরা মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করেন ।হাতে গোনা কিছু সংখ্যক নারীরা প্যাড ব্যবহার করেন। মালিকের সময় তাৎক্ষনিক ভাবে ন্যাকড়া পরিস্কার করতে না পেরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ বিষয় সনাকের সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, গোসলের সময় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা এটা নতুন কিছু নয়, বস্তি গুলোতে ঘন বসতি অনেক বেশি। বাথরুম নেই বললে চলে যা আছে তা পুরুষরাই ব্যবহার করেন। নারীদের জন্য আলাদা গোসল খানা ও টয়লেট নেই। একই টয়লেট আর গোসলখানা ব্যবহার করতে হয় নারীদের। এতে করে নারীরা গোসল ও টয়লেট ব্যবহার করতে না পেরে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরছেন। বিশেষ করে মাসিকের সময় পরিস্কার থাকতে হয়। নারীদের জন্য আলাদা বাথরুম ও টয়লেট দরকার। তিনি আরও বলেন আমি মনে করি এদের কি ভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার কাউন্সিলর, সমাজ সেবক , জনপ্রতিনিধি, এনজিও এ বিষয় উদ্যোগ নেয়া উচিত। সিটি কর্পোরেশন কিছু কিশোরী নারীদের বাথরুমে জন্য দরখাস্ত করা উচিত। জনস্বার্থে ২০টি করে টয়লেট করে দেয়া উচিত সমাজের বিত্তবানদের। তা না হলে আগামীতে নারী মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয় বিএনডিএন এর সভাপতি আনোয়ার জাহিদ বলেন, এটা বাস্তব সম্মত নয়। নারী সুরক্ষার জন্য এবং তাদের সকল দিক বিবেচনা করে শুধু নারীদের জন্য আলাদা বাথরুমে ও টয়লেট করে দিতে হবে। গোসলের সময় নারীরা কেন ভয়ে থাকবে। তাকে চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে। এমন বাড়ি আছে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২০/২৫ জন বাথরুম একটি। এটা ঠিক না। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। নারী সুরক্ষার জন্য প্রশাসন, জনগন, জনপ্রতিনিধি, সকলের সহায়তায় বাথরুমের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর নয় নারী নির্যাতন এটা বন্ধ করতে হবে।