ব্রিটিশ শাসনামলে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা (মিশনারি) বরিশালে আসেন। জানা যায়, উইলিয়াম কেরি পর্তুগিজ দস্যুদের কাছ থেকে জিন্নাত বিবি নামের এক মুসলিম মেয়েকে উদ্ধার করে তাকে লালন-পালন করেন। পরে এক মুসলিম যুবকের কাছে জিন্নাত বিবিকে বিয়ে দেয়া হয়। উইলিয়াম কেরি জিন্নাত বিবিকে জেনেট বলে ডাকতেন। ১৯০৮ সালে জিন্নাত বিবি জনগণের পানির কষ্ট দূর করার জন্য পুকুর খননের উদ্যোগ নেন এবং এ অনুযায়ী নগরীর সদর রোডের পূর্বপাশে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮৫০ ফুট প্রস্থ একটি পুকুর খনন করা হয়। তখন থেকেই পুকুরটি ‘বিবির পুকুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
একসময় কীর্তনখোলা নদীর সাথে এ পুকুরের দু’টি সংযোগ ছিল এবং এতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা প্রবাহমান ছিল। সংযোগ দু’টির একটি বরিশাল সার্কিট হাউজ হয়ে মৃতপ্রায় ভাটার খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলায় এবং অন্যটি নগরীর গির্জা মহল্লার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলুপ্ত খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলা নদীর সাথে যুক্ত ছিল।
সংস্কার ও উন্নয়ন : বরিশাল পৌরসভা স্থাপনের পর থেকেই বিবির পুকুরটি বিভিন্নভাবে সংস্কার ও পুনর্খনন করা হয়। ’৯০-এর দশকে পৌর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব কামাল পুকুরটির ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৩ সালে অ্যাডভোকেট মো: মজিবর রহমান সরোয়ার মেয়র থাকাকালে বিবির পুকুরের চারপাশ পাকা করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়।
২০০৮ সালে শওকত হোসেন হিরণ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিবির পুকুরের ঐতিহ্য রক্ষা এবং সৌন্দর্র্য বর্ধনে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বিশ্রাম নেয়ার জন্য বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরটির শোভা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের লাইটিং স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করেন। পাশাপাশি বিবির পুকুরের পাশেই উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র পাবলিক স্কয়ার (বর্তমানে হিরণ স্কয়ার নামে পরিচিত) এবং পুকুরের মধ্যে ফোয়ারা স্থাপন করেন।
বর্তমান অবস্থা : বিবির পুকুর বর্তমানে নাগরিক বিনোদনের একটি স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিকেলে ও সন্ধ্যায় জনগণ আড্ডা ও অবসর সময় কাটানোর জন্য পুকুর পাড়ে ও হিরণ স্কয়ারে জড়ো হয়। ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জনগণের জন্য পুকুরের চারপাশ ও হিরণ স্কয়ার এলাকায় ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা যুক্ত করা হয়। পুকুরটি শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় এবং যাতায়াত সুবিধা ভালো থাকায় অনেক রাত পর্যন্ত এখানে মানুষ ভিড় করে। পুকুরের পাশে বাহারি রকমের মুখরোচক খাবারও পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে চটপটি, ফুচকা, বুটমুড়ি, পিয়াজু ও নানান ধরনের চপ।
২০১২ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ও গ্রামীণফোনের অর্থায়নে বিবির পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বসার বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরের শোভা বৃদ্ধির জন্য লাইটিংকরণ, পুকুরটির ইতিহাস সংবলিত বিলবোর্ড, পুকুর ঘিরে বৃক্ষরোপণ, উন্নত ওয়াকওয়ে ও রঙিন ফোয়ারা স্থাপন।
এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে পুকুরটির সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও প্রকল্পের অনেক কিছুই এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেটুকু করা হয়েছে তার অনেকটাই এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে। বহুদিন ধরেই পুকুরের মধ্যকার রঙিন আলোর ফোয়ারাটি অচল হয়ে আছে। যাচ্ছেতাই বিলবোর্ড স্থাপনের কারণে পুকুরটির সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা: মিজানুর রহমান বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিবির পুকুর সংলগ্ন এলাকায় ওয়াই-ফাই জোনের ব্যবস্থা করায় এখানে তরুণ-তরুণীদের ভিড় বেড়েছে। পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনের লক্ষে ফোয়ারা ও আলোকসজ্জা সচল করা, অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ করাসহ ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরের নান্দনিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিটি করপোরেশনকে আরো বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি।