আউটসোর্সিংয়ের কাজে বিশ্বের সেরা ফ্রিল্যান্সারদের কাতারে যুক্ত হচ্ছে দেশের নারীদের নাম। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে মাত্র ৯ শতাংশ নারী এ কাজ করতেন। বর্তমানে সক্রিয় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। এসব নারী কোনোদিন আমেরিকায় যাননি, ইংল্যান্ডে যাননি, কিন্তু প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওইসব দেশের কোম্পানিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও আউটসোর্সিং করে কয়েকশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ১১ শতাংশই নারী (অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ জন)। বিশ্বব্যাংক, অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) এবং ই-প্ল্যাটফরমের সমীক্ষামতে, অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয় (বিশ্বের মোট বাজারের ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে)। প্রথম অবস্থানে আছে ভারত (২৪ শতাংশ)। বাংলাদেশের পরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্য। এসব কাজে পুরুষদের আয় যেখানে ঘণ্টায় ২১.৫৭ পাউন্ড, সেখানে নারীদের আয় ২২.৪৩ পাউন্ড।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও টেকনোলজি ক্যাটাগরিতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো, যারা বিশ্বের মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে। অর্থনীতির ভাষায় এটিকে ট্রিলিয়ন ডলার মার্কেট বলা হয়। মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫০ ভাগ হলে বাংলাদেশই নেতৃত্ব দেবে অনলাইন কাজের ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে। সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩২০ জন নারী আইটি প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যেখান থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি আইটি ফ্রিল্যান্সার তৈরি হয়েছে।
দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির ওপর। সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টার, ১৩ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩টি বিশেষায়িত ল্যাব ও ১০টি হাইটেক/আইটি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, ৫০০টি জয় ডি-সেট সেন্টার, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৩৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এগুলোর সবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিকে উৎসাহিত করবে। এগুলোর সঠিক ব্যবহারে ২০২৫ সালের মধ্যে ফ্রিল্যান্সিং খাতের আয় ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং একটি বিশাল জগৎ। ডাটা এন্ট্রি, ভিডিও এডিটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, আর্টিক্যাল/কনটেন্ট রাইটিং, ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ড্রপশিপিং, অনলাইন সার্ভে, ব্লগিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, লিড জেনারেশন, কাস্টমার সার্ভিস প্রভৃতি কাজ সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়েই শুরু করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন থাকলে এ কাজের পাশাপাশি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স (ডেটা অ্যানালাইসিস), এফিলিয়েট মার্কেটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রভৃতি অ্যাডভান্স লেভেলের কাজ করা যায় এবং এসব কাজে আয়ও বেশি।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবিধা হলো এ কাজে-১. কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কাজের সময় নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকে; ২. যে কোনো স্থান যেমন-বেডরুমে, গাড়িতে বা লাইব্রেরিতে বসে করা যায়; ৩. কাজ শুরু করতে কেবল ভালো মানের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার, কিছু সফটওয়্যার, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং বৈদেশিক অর্থ লেনদেনের জন্য অ্যাকাউন্ট প্রয়োজন; ৪. ব্যবসার ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী হওয়ায় গ্রাহকসংখ্যাও অগণিত, তাই থেমে থাকার সুযোগ নেই।
ফ্রিল্যান্সিং করে দেশ-বিদেশে যেসব নারী পরিচিতি পেয়েছেন তারা হলেন-১. ময়মনসিংহের ফ্রিল্যান্সার আতিয়া শাহানা, যিনি ফ্রিল্যান্সিং জগতে আসেন তার জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে; ২. নীলফামারীর রাজিনা খান। বিশ্ববিখ্যাত ইল্যান্স ও ওডেস্কে গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করেন তিনি; ৩. রংপুরের ফাহমিদা মৌরীষ ফ্রিল্যান্সিং শিখে মাত্র ১৪ দিনের মাথায় কাজ পান তিনি; ৪. রংপুরের আরেক মেয়ে শারমিনা মাহমুদা কবির, ফ্রিল্যান্সার থেকে এখন এন্ট্রাপ্রেনিউর; ৫. মুন্সীগঞ্জের নুসরাত জাহান; আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়ে; ৬. রাজশাহীর শাহরিনা ইয়াছমিন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ওয়েবভিত্তিক অ্যাপ তৈরির কাজ করছেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী স্বামীর আগ্রহে; ৭. আফরোজা বেগম একজন সফল ফ্রিল্যান্সারের নাম। ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সংসদ-সদস্য শামীম ওসমানের হাত থেকে ল্যাপটপ পুরস্কার পেয়ে তিন রঙের করপোরেট ইনভয়েস ডিজাইনের কাজ করেন; ৮. সাজেদা রহমান সেতু গ্র্যাজুয়েশন করে চাকরি না পেয়ে অনেকটা হতাশা থেকেই ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে এখন পেশাদার ফ্রিল্যান্সার; ৯. রুপালী রানী গোপ, পড়ালেখার পাশাপাশি রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং শিখে এখন মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছেন, পরিবারের লোকরাও তাকে এখন সহযোগিতা করছেন; ১০. আরিফা আক্তার মিম মায়ের সঙ্গে কলেজে পড়া অবস্থায় আইসিটি মেলায় গিয়ে পরিচয় ফ্রিল্যান্সিং শব্দের সঙ্গে, আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে; ১১. সিলেটের সৈয়দা নাহিদা আখতার নিপা, গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন একজন সফল গ্রাফিক্স ডিজাইনার; ১২. চট্টগ্রামের আসমিকা মিথিলা, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং শিখে এখন স্বাবলম্বী, পরিবারকেও আর্থিক সাহায্য করতে পারছেন।
নিজের পরিবার সামলে এবং সন্তান লালনপালন করেও নারীরা আজ তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং কাজে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়াচ্ছেন, আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। নারীর এ অগ্রগতি দেখে নিজ পরিবার থেকেই এখন উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, কোথাও কোথাও স্বামী-স্ত্রী এবং মা-মেয়ে মিলে একসঙ্গে আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং করছেন, যা কয়েক বছর আগেও ছিল ঠিক বিপরীতটি। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর ধৈর্য এবং কর্মক্ষেত্রে কাজ করার প্রবণতা পুরুষের চেয়ে বেশি। শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি, উদ্যোগ ও ক্রীড়ায় নারীর সাফল্য আজ সর্বত্র। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের অবদান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ৯ ডিসেম্বর ‘বেগম রোকেয়া দিবস-২০২২’ এবং ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২২’ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে নারীদের ফেসবুক না দেখে ফ্রিল্যান্সিং করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। স্বল্পমূল্যে ডিজিটাল সেন্টারগুলোয় ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে এবং ইউটিউবে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রচুর কোর্স আপলোড করা আছে। ইচ্ছা করলেই এগুলো দেখে দেখে আউটসোর্সিং পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। আইসিটি, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করলে পিছিয়ে পড়া গ্রামের নারীরা এ কাজে সম্পৃক্ত হতে অনুপ্রাণিত হবেন। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে গ্রামের নারীরাও থাকবেন না পিছিয়ে।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়