সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের করপোরেট প্রতিষ্ঠান মেটা। মেটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া বিষয়টি সহজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, মেধা আর স্বপ্ন জয়ের অদম্য ইচ্ছা। এমন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন বুনতে পারেন শুধু যোগ্যরাই। তবে সেই স্বপ্ন সবার পূরণ হয় না।
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের ছোনকা গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে পৌঁছে দিয়েছে ফেসবুকের প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে পৌঁছানোর পথ এত সহজ ছিল না।
পদে পদে এসেছে বাধা। অনেক সময় থেমে যেতে হয়েছে, ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মানসিক শক্তি আরও দৃঢ় করে সামনে এগিয়ে গেছেন। বাবা-মায়ের দোয়া, স্ত্রীর দেওয়া মানসিক শক্তি আর নিজের প্রবল ইচ্ছা তাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। আজ তিনি ফেসবুকের করপোরেট প্রতিষ্ঠান মেটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কীভাবে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন তা জানতে চাইলে মেটা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশলী) হওয়ার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ ছোটবেলা থেকেই শারীরিক নানা সমস্যা ছিল।
একিউট অ্যাজমা (তীব্র হাঁপানি) আর বাতজ্বর ছিল। এসএসসিতে খারাপ রেজাল্ট হয়। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম নটর ডেম, রেসিডেনশিয়ালসহ বেশ কয়েকটি কলেজে। দুর্ভাগ্যবশত কোথাও ভর্তির সুযোগ পেলাম না। এর পর থিসিসের চেয়ে জিআরই-তে বেশি সময় দিয়ে ফেললাম। ফল ফাইনালে সিজিপিএ কমে গেল। শুধু তাই নয়, গণিত আর ইংরেজিতে এতটাই বাজে ছিলাম যে, জিআরই-তে ১৬০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৯৫০ পেলাম, যা দিয়ে কোথাও আবেদন করা সম্ভব নয়। তখন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
এমন অবস্থায় একটি বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে যোগ দিলাম। তখনো যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার সুপ্ত আশা রয়ে গেছে। হাল ছাড়লাম না। এর মধ্যে কাকতালীয়ভাবে বিয়ে করে ফেললাম। শুরু হলো সংসার জীবন। হঠাৎ একদিন ইমেইল পেলাম সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি থেকে। খুব আগ্রহ আর খুশি মনে মেইলটা খুলে দেখলাম সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আপনি কন্ডিশনালি একসেপ্টেড। মানে আমাকে আবার জিআরই দিতে হবে। মুখটা ফের কালো হয়ে গেল। কিছু দিন পর রিপ্লাই দিলাম, আমার পক্ষে পুনরায় জিআরই দেওয়া সম্ভব না।
আমি আবারও জিআরইয়ের জন্য রেজিস্ট্রেশন করলাম। এর মধ্যেই দিনে ল্যাবে থিসিস আর রাতে জিআরই প্রস্তুতি সমান তালে চালাতে থাকলাম। পরীক্ষা দেওয়ার পর জিআরইর রেজাল্ট এলো। এবার মোটামুটি আবেদন করার মতো স্কোর পেলাম। এমএস শেষে কাতার ইউনিভার্সিটি থেকে জবের অফার পেলাম। জয়েন করে ওখান থেকেই অধ্যাপকদের ই-মেইল করতাম।
প্রোফাইল ভালো না হওয়ায় খুব একটা রিপ্লাই পেতাম না। তার পরও ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচটা ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করে ফেললাম। তিন মাস অপেক্ষার পর দুটি ইউনিভার্সিটি থেকে ফুল ফান্ডসহ স্কলারশিপের অফার পেলাম। শুরু হলো এফআইইউ-তে পিএইচডি জার্নি। তার পর ফেসবুক, গুগলের মতো জায়গায় লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম। আগে-পিছে না ভেবে সাহস করে জিরো থেকে কোডিং প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম।
কিন্তু লিটকোডে প্রলেম সলভ করতে গিয়ে দেখি, সলভ তো দূরের কথা আমি প্রশ্নই ঠিকমতো বুঝি না। হতাশ হয়ে যেতাম যখন দেখতাম সারাদিনে একটা ইজি প্রবলেমও সলভ করতে পারছি না। কিন্তু জানতাম হাল ছাড়লে চলবে না, আমাকে পারতেই হবে। উইকডেইজে ল্যাবের কাজ শেষ করে রাতে অনুশীলন করতাম। পারতাম না, কিন্তু আবার শুরু করতাম। ছুটির দিনগুলো কাজে লাগাতাম। মাস দুয়েক পর আবিষ্কার করলাম যে আমি এখন নিজেই ইজি প্রলেমগুলো সলভ করতে পারছি।
আরও কয়েক মাস প্র্যাকটিসের পর বুঝতে পারলাম আমি এখন ইন্টারভিউয়ের জন্য রেডি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রথম ডাক পেলাম ইনটেল থেকে। দুই দফার সাক্ষাৎকারে পাস করার পর ডাক পেলাম ফাইনাল রাউন্ডে। ১৩ পর্বের সেই ফাইনাল রাউন্ড টেনেটুনে ভালোই হলো।
কয়েক দিন পর ইনবক্সে ফের রিজেকশন ই-মেইল পেলাম। হতাশা যখন চরম পর্যায়ে, মানসিক অবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে; ঠিক তখনই একটি স্টার্টআপ কোম্পানি থেকে প্রথম জব অফার পেলাম। এটা যে কী আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এর কিছু দিন পরই ফেসবুক থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক এলো। আমার মধ্যে তখন স্বপ্নছোঁয়ার আশা ফের বাসা বাধতে শুরু করে দিয়েছে।
এই স্টেপে নানা ধরনের পরীক্ষা দিতে হয়। রোলার কোস্টারের মতো দীর্ঘ সাত ধাপ পেরিয়ে গেছি, একদিন বিকালে হঠাৎ ফেসবুক থেকে এলো কাঙ্ক্ষিত কল। সেটা যে কী আনন্দের, তা বলে বোঝাতে পারব না। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো— আপনার সব ইন্টারভিউ ভালো হওয়ায় মেটা (ফেসবুক) আপনাকে হেড অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার (এমএল) হিসেবে অফার করছে।’ আমি বাকরুদ্ধ ছিলাম। সেই মুহূর্তটা অন্যরকম এক ভালো লাগার ইতিহাস।