ফকির আলমগীর: লাল মিয়া থেকে বাংলাদেশের গণসঙ্গীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী
প্রকাশ: ২৫ জুলাই, ২০২১, ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ |
অনলাইন সংস্করণ
বিবিসি বাংলা :
“ছেলেটার হাতে থাকতো একটা বাঁশি, পরনে সাদা, ঢোলা পায়জামা, পাঞ্জাবি। শুরুর দিকে একটু লাজুক ছিল। নাম জিজ্ঞেস করলাম, বললো লাল মিয়া, ওরফে ফকির আলমগীর” – এভাবেই দীর্ঘদিনের বন্ধু ফকির আলমগীরের সাথে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন সঙ্গীতশিল্পী তিমির নন্দী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোলকাতায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল গঠনের কাজ করার সময় ফকির আলমগীরের সাথে প্রথম পরিচয় হয় তিমির নন্দীর।
সেসময় নিজের কণ্ঠ নিয়ে কিছুটা হীনমন্যতা কাজ করতো ফকির আলমগীরের মধ্যে।
“সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠ হয়, তখন একদিন হাসতে হাসতেই বললো ‘দোস্তো, গান গাবো কেমনে, গলা তো ফাটা বাঁশ।'”
“যার নিজের গলা নিয়ে সন্দেহ ছিল, সেই ছেলেই যে একদিন গান গেয়ে মানুষের মন জয় করবে, তা কে জানতো?”, বলছিলেন তিমির নন্দী।
যৌবনে নিজের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও পরবর্তীতে ফকির আলমগীর বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সাথে সংযোগ তৈরির সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম সঙ্গীত।
২০১২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার মতে, জনসংযোগে সঙ্গীতের কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গীত হতে পারে মানুষের কল্যাণে, এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার একটা মাধ্যম।”
ফকির আলমগীর সারা জীবন নিজের এই মূল্যবোধে অটুট ছিলেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার গানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন, চেষ্টা করেছেন শ্রমজীবি, প্রান্তিক মানুষের গল্প তুলে ধরে তাদের জীবনের কল্যাণ সাধনের।
১৯৬৬ সালে ১৬ বছর বয়সে জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময়ই রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন ফকির আলমগীর। আর সেখান থেকেই শুরু গণসঙ্গীতের চর্চা।
“শ্রেণী সংগ্রামের গান, মানবমুক্তির গান, লড়াইয়ে শপথে উদ্দীপ্ত করার যে গান, সেটাই আমি গাওয়ার চেষ্টা করি। যতদিন শ্র্রেণী বৈষম্য থাকবে, শোষণ-বঞ্চনা থাকবে, অন্যায়-অবিচার থাকবে, ততদিন গণসঙ্গীতের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না।”
সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে ফকির আলমগীর মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে গান তৈরি করেছেন, গান তৈরি করেছেন প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনের বাস্তবতা নিয়ে।
ফকির আলমগীরের দীর্ঘ সময়ের সহযোগী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, সাধারণ মানুষকে নিয়ে গান লেখার পেছনে ফকির আলমগীরের কোনো স্বার্থ বা বৈষয়িক চিন্তা ছিল না। মানুষের জন্য ভালোবাসা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষের জন্য গান তৈরি করেছেন।
“এমনও হয়েছে যে, একজন রিকশাওয়ালা ঘর্মাক্ত অবস্থায় ফকির আলমগীরের কাছে এসেছেন তাকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানাতে। ফকির আলমগীর তাকে বুকে জড়িয়ে নিতেন। রিকশাওয়ালার শরীরের ঘাম, ময়লায় তার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে, এরকম চিন্তা তিনি কখনো করতেন না।”
“এজন্য শুধু প্রান্তিক মানুষ বা শ্রমজীবি মানুষ নয়, আমি উচ্চবিত্ত বা নতুন প্রজন্মের অনেককেও দেখেছি ফকির আলমগীরের বড় ভক্ত হতে। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত সরল।”
তিমির নন্দীর মতে, সমসাময়িক নানা ঘটনা নিয়ে গান তৈরি করায় সাধারণ মানুষের কাছে ফকির আলমগীরের গ্রহণযোগ্যতা অন্য সঙ্গীতশিল্পীদের চেয়ে বেশি ছিল।
“সাধারণ ঘটনা নিয়ে গান রচনা করে, মানুষকে পৌঁছে দেয়া, মানুষের মনের ভেতরে যাওয়া, এটা ছিল ফকির আলমগীর। যে কোনো ক্রান্তিকালেও ও দেখা যেত একটা গান রচনা করে সুর করে গাইতো। তার সমসাময়িক অন্য কোনো শিল্পী কিন্তু তা করেনি।”
রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, জগন্নাথ হল দুর্ঘটনা বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত অপরাধ নিয়েও গান গেয়েছেন ফকির আলমগীর। আর এসব গানই তাকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের কাছে।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান সম্ভবত ‘ও সখিনা, গেসস কিনা ভুইলা আমারে।’ এই সখিনা চরিত্রটিকে নিয়ে তার বেশ কয়েকটি গান রয়েছে। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর জানিয়েছিলেন কেন এই সখিনা তার অনেক গানের প্রধান চরিত্র হিসেবে স্থান পেলো।
“সখিনা একটি প্রতীকি সত্ত্বা। এই সখিনার মাধ্যমে আমাদের দেশের সব নির্যাতিত নারীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”
“সখিনা আমার গানে এসেছে একজন নি:সঙ্গ নারী, নির্যাতিত নারী রূপে। সখিনা একজন মা, কারো আহ্লাদী বোন, কখনো এক সরল পল্লীবালার প্রতীক, আর কখনো প্রথম প্রেমের প্রতীক হিসেবে এসেছে আমার গানে।”